নিজস্ব প্রতিনিধি:
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে লবণাক্ততা বেড়েছে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে। আর মাত্রাতিরিক্ত এসব লোনা পানির দৈনন্দিন ব্যবহারের ফলে জরায়ু সংক্রান্ত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন এসব এলাকার নারীরা। সেজন্য অল্প বয়সেই জরায়ু কেটে ফেলতে বাধ্য হচ্ছেন এই এলাকার অনেক নারীই।
সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর থানার দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরার ৯ নম্বর সোরা গ্রামের আসমা বেগম (৩০)। সাত বছর আগে মাত্র ২৩ বছর বয়সে অপারেশনের মাধ্যমে জরায়ু কেটে ফেলেন তিনি।
আসমা সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ছোট থেকেই আমার ধাতুর (সাদাস্রাব) সমস্যা ছিল। বিয়ের পরে প্রথম সন্তান জন্মের পর থেকেই জরায়ুতে জ্বালা-পোড়া ও যন্ত্রণা হতো। একে একে তিন সন্তান জন্মের পর জানলাম জরায়ুতে ঘা হয়েছে। তখন অবস্থা খুব খারাপ ছিল। পরে খুলনার এক হাসপাতালে ভর্তি হলে অপারেশন করে জরায়ু ফেলে দেন ডাক্তার।
তিনি বলেন, আমার বাবার বাড়ি ও শ্বশুরবাড়ি গাবুরা ইউনিয়নেই। ফলে জন্ম থেকেই লোনা পানির সাথে বসবাস। তবে আগের তুলনায় যেন লোনাভাব বেড়েছে। গরমকালে লোনাভাব এত বাড়ে যে, পুকুরের পানি মুখেই নিতে পারি না। অথচ তাতেই গোসলসহ সব কাজ করতে হয়।
আসমার চেয়ে কম বয়সে জরায়ু ফেলতে বাধ্য হয়েছেন তার প্রতিবেশী রওশন আরা পারভীন (২৭)। তার গল্পও একই রকম। প্রায় বছর চারেক আগে জরায়ুতে টিউমার দেখা যায়। সে কারণে পুরো জরায়ু ফেলে দেয়া হয় তার। জরায়ু অপারেশনের পর দুজনেরই স্বামী তাদের ফেলে অন্যত্র বিয়ে করেছেন।
শুধু গাবুরা নয়, উপকূলীয় উপজেলা শ্যামনগরের প্রতিটি গ্রামে জরায়ু সংক্রান্ত রোগে ভুগছেন এমন নারীর সন্ধান পাওয়া যাবে। পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, নারীদের জরায়ু সংক্রান্ত অসুখের তীব্রতা লোনাপানিপ্রবণ গ্রামগুলোতে বেশি।
শ্যামনগরের প্রতাপনগর ইউনিয়নের রুইয়ার বিলের বাসিন্দা আমিনা বেগম (২৮) সংবাদমাধ্যমকে বলছিলেন, আমার তলপেট খুব ব্যথা করে, কোমরের অংশ অবশ হয়ে যায়, মনে হয় পেটের ভেতর থেকে কিছু একটা ছিঁড়ে নিচে নেমে আসছে। তাছাড়া প্রচণ্ড সাদাস্রাব হয় আর চুলকায়। ঘণ ঘণ প্রস্রাব হয়। আর প্রসাব করতেও খুব কষ্ট হয়।
‘গ্রামের ডাক্তাররা জরায়ু কেটে ফেলার পরামর্শও দিয়েছেন। কিন্তু এই বয়সে অপারেশন করাতে স্বামী রাজি হননি। আপাতত চিকিৎসা নিচ্ছি। কিন্তু খুব বেশি হলে ১০-১৫ দিন ভালো থাকি।’
শ্যামনগরের তিনটি বেসরকারি ক্লিনিকের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বছরে মোট অপারেশনের প্রায় ১০ শতাংশ রোগীর জরায়ু অপারেশন হয়ে থাকে। এসব ক্লিনিকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জরায়ু ফেলে দেয়ার হার বেশি।
বার্ষিক হিসাব পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১৯ সালে সুন্দরবন নার্সিং হোমে শতকরা ৫ জন রোগীর জরায়ু অপারেশন হয়েছে। একই বছরে নগর ক্লিনিকে রোগীদের প্রায় ৮ শতাংশের হয়েছে জরায়ু অপারেশন। এছাড়া বংশিপুর ক্লিনিকে শতকরা ১১ জনের হয়েছে জরায়ু অপারেশন।
শ্যামনগরের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে অন্তত ৬০ জন নারীর সাথে কথা হয়েছে, যারা জরায়ু সংক্রান্ত রোগে ভুগছেন। এদের মধ্যে অন্তত ২৫ জনের ইতিমধ্যে অপারেশন করে জরায়ু ফেলে দেয়া হয়েছে। বাকিরা বিভিন্ন জটিলতায় ভুগছেন। কেউ কেউ জরায়ু ফেলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
চিকিৎসকরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে জরায়ু সমস্যায় ভুগতে থাকলে তা ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।
শ্যামনগরে অবস্থিত ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত জরায়ুর অসুখের মাত্রার পরিপ্রেক্ষিতে ৩৮০ জন নারীর ভ্যাজাইনাল ইনফেকশন অ্যাসেসমেন্ট করা হয়। এদের মধ্যে ২৩ জনের ক্যান্সারের মারাত্মক ঝুঁকি রয়েছে। পরবর্তী চিকিৎসার জন্য তাদের দুইজনকে ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং বাকিদের খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করা হয়।
শ্যামনগর ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. তাসনুভা আফরিন সংবাদমাধ্যমকে বলেন, হাসপাতালে আমি মাসে গড়ে প্রায় নয়শ’ রোগী দেখি। এদের মধ্যে ১০-১২ জন রোগী পাই যাদের জরায়ু ফেলে দেয়া হয়েছে। এছাড়া জরায়ু সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে আসা রোগীর সংখ্যাও তুলনামূলক বেশি।
‘কমিউনিকেশন গ্যাপ, অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে জরায়ু কেটে ফেলাটাকেই তারা সমাধান মনে করেছেন। কিন্তু এর ফলে তাদের শারীরিক সমস্যা আরও বেড়ে যাচ্ছে। অনেকের সংসারই ভেঙে যায়। হট ফ্লাস (হাত-পা ও শরীর জ্বালা-পোড়া), অল্পতে উত্তেজিত হয়ে যাওয়ার মতো অসুবিধা হতেই থাকে’ বলেন তিনি।
ডা. তাসনুভা অবশ্য মনে করেন, জরায়ু সংক্রান্ত রোগের সঠিক চিকিৎসা প্রয়োজন। এ এলাকার নারীরা সঠিক গাইডলাইন না পাওয়ার কারণেই জরায়ু ফেলে দিতে বাধ্য হন।
২০১৮ সালে ‘সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাবে লবণাক্ততার প্রভাব’ শীর্ষক একটি গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকার নারী ও কিশোরীরা মাসিকের সময় ব্যবহৃত কাপড় লবণ পানিতে ধুয়ে আবারও সেটি ব্যবহার করে। এর ফলে নানা ধরনের অসুখে আক্রান্ত হয় তারা। সূত্র: জাগো নিউজ