সারাদেশ

৮০ বছর পত্রিকাসেবা করে এখন ভিক্ষুক

নিজস্ব প্রতিনিধি, লহ্মীপুর: কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ, পরনে বিবর্ণ শার্ট, লুঙ্গি ও ডান হাতে লাঠি। সব আগে মতো থাকলেও শুধু পাল্টেছে পেশা। ছিলেন শ্রমজীবী এখন ভিক্ষুক। জীবনের গতিপথ কোথা হতে কোথা যায়!

জীবনের ৮০টি বছর কাটিয়ে দিয়েছেন পত্রিকা বিক্রি করে। কিন্তু যে হাতে পত্রিকা নিয়ে ঘুরে ফিরতেন অলিগলি, এখন সেই হাতেই ভিক্ষার ঝুলি। লক্ষ্মীপুর পৌর শহরের বাঞ্চানগর গ্রামের পত্রিকা হকার সৈয়দ আহম্মদের দৈনন্দিন কাজের চিত্রিএটি। দীর্ঘদিন ধরে মানবেতর জীবনযাপন করছেন একশ’ বছরের বেশি বয়সী এই পত্রিকাসেবী।

তার ছয় ছেলে, মেয়েরাও ষাটোর্ধ্ব বয়সী। এক ছেলে আবুল কালাম (৬০) বাবার পেশা পত্রিকা বিক্রি ধরে রেখেছেন। কিন্তু বর্তমান প্রযুক্তির যুগে পত্রিকা বিক্রির পয়সায় তারও সংসার চলে না। অন্য ছেলেদের কোনোভাবে সংসার চললেও ষাট বছর বয়সী স্বামী পরিত্যক্তা দুই মেয়ে আর শতবর্ষী স্ত্রীসহ চারজনের মুখে দুমুঠো খাবার তুলে দিতে ভিক্ষাবৃত্তির মাধ্যমে এখন জীবন চালাচ্ছেন তিনি।

প্রবীণ পত্রিকাসেবী সৈয়দ আহম্মদ একসময় লক্ষ্মীপুরের পথে-ঘাটে পত্রিকা নিয়ে হাজির হতেন মানুষের ধারে। স্থানীয়ভাবে ‘সৈয়দ হকার’ নামে পরিচিত এই ব্যক্তি জীবনের ৮০টি বছর কাটিয়ে দিয়েছেন পত্রিকা বিক্রি করে। স্থানীয় পত্রিকা সংশ্লিষ্টদের মতে, বাংলাদেশে সবচেয়ে আদি পত্রিকা বিক্রেতা সৈয়দ আহম্মেদ। তবে এখন ভিক্ষাবৃত্তিই তার পেশা। লাঠিতে ভর করে লক্ষ্মীপুর শহরে ঘুরে বেড়ান জীবিকার সন্ধানে। চোখে ঠিকমতো না দেখলেও তিনবেলা আহারের খোঁজে প্রতিদিনই বের হন পথে-ঘাটে। পুরোনো পত্রিকার গ্রাহকরা তাকে দেখলেই জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দেন।

কাগজে-কলমে শিক্ষিত না হলেও সৈয়দ আহমেদের হৃদয় ছিলো আলোকিত। তার জীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে চরম দুঃখ-কষ্টে। তবুও হৃদয়বান এ মানুষটি শিশুদের পাঠশালার জন্য দান করেছেন পৌরসভার চার শতক জমি। আর মুসল্লিদের জন্য দিয়েছেন মসজিদের জায়গা।

শতবর্ষী সৈয়দ আহম্মদ জানান, বয়স প্রায় ১১২ বছরের কাছাকাছি। এ বয়সে আর ভিক্ষার ঝুলি বহন করতে পারছেন না। কর্মজীবনের শুরুতে প্রথমে নৌকায় কাজ করতেন। এরপর স্থানীয় এক মাওলানার সহযোগিতায় প্রায় ৮৫ বছর আগে পত্রিকা বিক্রির কাজ শুরু করেন তিনি। সাল-তারিখটা ঠিক মনে করতে পারছিলেন না। তবে ইংরেজ আমলে ভারতীয় ‘পয়গাম’ পত্রিকা বিক্রি করেছেন। পরে আজাদ, ইত্তেফাক, যুগশঙ্খ আর সংবাদ পত্রিকা বিক্রি করতেন। দুই পয়সা, চার পয়সায় পত্রিকা বিক্রি শুরু করেছিলেন তিনি।

তিনি বলেন, সেসময় ছোট এই লক্ষ্মীপুরে সরাসরি পত্রিকা আসতো না। নোয়াখালীর চৌমুহনীতে রেলগাড়িতে পত্রিকা আসতো। সেখান থেকে বাসে করে লক্ষ্মীপুরে পত্রিকা নিয়ে আসতাম। তারপর তা পাঠকের হাতে পৌঁছে যেত প্রকাশের তিন-চার দিন পর। প্রতিদিন পত্রিকা পৌঁছে দেয়াও সম্ভব হতো না।

তিনি আরও জানান, কিছু সময় ডাক-হরকরারা পায়ে হেঁটে পত্রিকা পৌঁছে দিতেন। তখনও সকাল বেলার পত্রিকা আসতে সন্ধ্যা হয়ে যেত। সন্ধ্যার সময় পত্রিকা বিক্রির জন্য বের হতেন তিনি। এভাবে নিজের অজান্তেই পত্রিকার সাথে নিজের জীবনকে পুরো জড়িয়ে নেন সৈয়দ আহমদ। তারপর টানা প্রায় ৮০ বছর পত্রিকা বিক্রির সাথেই ছিলেন। শারীরিক অসুস্থতার কারণে গত কয়েক বছর থেকে আর পত্রিকা বিক্রি করতে পারছেন না তিনি। কালের বিবর্তনে বিভিন্ন রোগ আর বয়সের ভারে কর্মক্ষমতা হারিয়ে পত্রিকা ছেড়ে ভিক্ষার ঝুলি হাতে নেন।

অতীতের প্রসঙ্গ তুলতেই সৈয়দ আহম্মদ জানান, পত্রিকা বিক্রিকালেই তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ১৯৪৭ সালের ভারত ভাগ, ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এবং ৯০-এর গণ-আন্দোলনসহ সব ঐতিহাসিক আন্দোলনের স্বাক্ষী তিনি।

সরকারি সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন কিনা জানতে চাইলে শতবর্ষী বৃদ্ধ সৈয়দ আহম্মদ জানান, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সমাজসেবা কার্যালয়ের সহযোগিতায় নিজের আর স্ত্রীর বয়স্ক ভাতার কার্ড করিয়েছেন। এই দুটি কার্ডের অর্থ ও ভিক্ষার টাকা দিয়ে কোনোরকম সংসার চলছে।

লক্ষ্মীপুরের পত্রিকা এজেন্ট মেসার্স রহমানিয়া প্রেসের পরিচালক রাকিব হোসেন বলেন, ছোটবেলা থেকে দেখতাম প্রতিদিন সকাল সাড়ে ৭টা থেকে ৮টার মধ্যে রহমানিয়া প্রেসে চলে আসতেন সৈয়দ চাচা। মাঝে মাঝে সকাল বেলা দোকান খুলতে এসে দেখতাম সৈয়দ কাকা বসে আছেন। প্রায় সময়ই তিনি আমাদের আগেই এসে বসে থাকতেন। অনেক সময় রাত পর্যন্তও তিনি পত্রিকা বিক্রি করতেন। পত্রিকার গাড়ি এসে পৌঁছালেই ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। শুরু হয় যেতো তার কাজ। কাজের সময় তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হতো না। বর্তমানে ভিক্ষাবৃত্তিতেই সংসার চালাচ্ছেন।

লক্ষ্মীপুর প্রেসক্লাবের সভাপতি হোসাইন আহম্মদ হেলাল জানান, লক্ষ্মীপুর জেলার সব সময়ের হাজার ঘটনার স্বাক্ষী খবরের ফেরিওয়ালা সৈয়দ আহম্মদ। পাঠকের কাছে পত্রিকা পৌঁছে দেয়াই ছিলো তার কাজ। বাম হাতে একটি লাঠি আর কাঁধে ব্যাগ, পরনে পুরোনো বিবর্ণ শার্ট-লুঙ্গি, ডান হাতে পত্রিকা নিয়ে ঘুরে ফিরতেন অলিগলি। কখনো কখনো লক্ষ্মীপুর শহরের পুলের ওপরে বসেও পত্রিকা বিক্রি করতেন তিনি।

এখনো তার কাঁধে ঝোলানো আছে সেই ব্যাগ, আর পরনে পুরোনো বিবর্ণ শার্ট, লুঙ্গি ও ডান হাতে সেই লাঠিও আছে। কিন্ত নেই শুধু পত্রিকা। এখন তার সময় যাচ্ছে অতিকষ্টে। সমাজের বিত্তবানদের সৈয়দ আহাম্মদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান হোসাইন আহম্মদ হেলাল।

সান নিউজ/এফএআর

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

সবজির বাজারে স্বস্তি

নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে কমেছে পেঁয়াজ, সবজি...

নলছিটিতে ফুটবল টুর্নামেন্ট শুরু

ঝালকাঠি প্রতিনিধি: ঝালকাঠির নলছিটিতে শুরু হয়েছে ভূট্টো স্মৃত...

স্বামীকে মৃত দেখিয়ে মামলা, নারী আটক

জেলা প্রতিনিধি : সাভারের আশুলিয়ায় জীবিত স্বামীকে বৈষম্যবিরোধ...

বড় দুর্ঘটনা থেকে বাঁচলেন পূজা 

বিনোদন ডেস্ক: ঢাকাই চিত্রনায়িকা ও মডেল পূজা চেরি ডজনখানেক ছব...

বৈষম‌বিরোধী আন্দোলনে বেঁচে ফেরার আশা করেনি

নিজস্ব প্রতিবেদক: ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকারের পতন আন্দোল&zwnj...

সাগরে লঘুচাপ সৃষ্টি

নিজস্ব প্রতিবেদক : বঙ্গোপসাগর এলাকায় একটি লঘুচাপ সৃষ্টি হয়েছ...

ফের বাড়ল সোনার দাম

নিজস্ব প্রতিবেদক : দেশের বাজারে ফের সোনার দাম বাড়ানোর ঘোষণা...

ফের হারলো সাকিবের দল

স্পোর্টস ডেস্ক : আবুধাবির টি-টেন টুর্নামেন্টে ফের হারের মুখ...

নোয়াখালীতে দুই গৃহবধূর লাশ উদ্ধার

নোয়াখালী প্রতিনিধি : নোয়াখালীতে পৃথক স্থান থেকে দুই গৃহবধূর...

ঢাকাবাসীকে নিরাপদ রাখতে হবে

নিজস্ব প্রতিবেদক : ঢাকাবাসীকে যেকোনো উপায়ে নিরাপদ রাখতে হবে...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা