ছবি ও প্রতিবেদন: রাশেদুর রহমান রাশু, বেনাপোল (যশোর)
নাভারন-সাতক্ষীরা মহাসড়কের ধারে যশোরের শার্শা উপজেলার নীলকান্ত মোড় সংলগ্ন বাওড়ে পাট ধোয়ার কাজে ব্যস্ত সামটা গ্রামের আছিয়া খাতুন (৫২), মমতাজ বেগম (৪০), জুবাইদা খাতুন (৫০), ফতেমা বেগম (৩৫), কুলসুম খাতুন (৩২), হাছিনা বানু (২৮) আর মাখলার বিলে টেংরা গ্রামের তছলিমা খাতুন (৪৫), খুকুমনি। তাদের এখন দম ফেলারও যেন সময় নেই।
পাট ধোয়া আর আঁশ ছাড়ানোর কাজে ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ব্যস্ত তারা। মধুর এই দৃশ্য ক্যামেরায় ধারণ করতে গেলে আছিয়া বেগম বলেন, ‘ওগো বিটা, কত্তেছো কী? ফটোক তুলো না। আমাগের নাতি-পুতিরও বিয়ে-শাদি হয়ে গেছে। আমরা এই কাজ কত্তিছি, তারা এই ফটোক দেখলি রাগ করবেনে!’
উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, চলতি মৌসুমে শার্শায় পাট কাটা, জাগ দেওয়ার কাজে পুরুষরা ব্যস্ত থাকলেও পাটকাঠি থেকে আঁশ ছাড়ানো ও পাটের আঁশ শুকানোর কাজে অংশ নিচ্ছেন বিভিন্ন গ্রামের প্রায় ১৩ হাজার নারী। পুরুষদের পাশাপাশি এই কাজে কিছুটা বাড়তি আয়ের মুখও দেখছেন তারা।
বেনাপোল পোর্ট থানার পুটখালী গ্রামের ময়না বেগম জানান, এক আঁটি পাট ছাড়ালে পাওয়া যায় ২০ টাকা। একজন নারী দিনে ২০ থেকে ৩০ আঁটি পাটের আঁশ ছাড়াতে পারেন। অন্য সময় ক্ষেতমজুর হিসেবে কাজ করলে যে টাকা মেলে, পাট ধোঁয়ার কাজে পাওয়া যায় তার তিনগুণ বেশি।
অনেকে আবার কাজটি করছেন পাটকাঠি নেওয়ার শর্তে। এতে সংসারের ব্যয় নির্বাহে কিছুটা হলেও সহযোগিতা করতে পারছেন তারা। এ কারণেই সংসারের কাজের পাশাপাশি পাট মৌসুমে পাট ছাড়ানোর কাজে যোগ দিচ্ছেন নারীরা।
মহিশাকুড়া খালে পাট ধোয়ায় ব্যস্ত বিধবা শবে বিবি (৫০), বাক প্রতিবন্ধী সুফিয়া খাতুন (২৫), দিনমজুর শাকিলা খাতুন (৪৫)। শবে বিবি বলেন, ‘দুপুর অব্দি কুড়ি গল্লা পাট ধুতি পারি। মাঠে জোন দিলি পাই ২০০ টাকা। এখেনে পাচ্ছি ৪০০ টাকা। ময়লা পানিতি কাজ করতি হয়। তাই গা হাত পা একটু চুলকোয়, বেড়ে পোকায় কামড়ায়। তবুও আয় বেশি, তাই এই কাজ করি।’
এদিকে উপজেলার অনেক হাট-বাজারে শুরু হয়েছে আগাম পাট বিক্রি। বাগআঁচড়ার পাটচাষি মোজাম গাজি জানালেন, প্রতিমণ পাট বিক্রি হচ্ছে দুই হাজার টাকা থেকে দুই হাজার ১০০ টাকায়। প্রতি আঁটি পাটকাঠি বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকায়।
উপজেলার গোড়পাড়া গ্রামের আতিয়ার রহমান জানান, মৌসুমের শুরুতে বৃষ্টি ও আম্পান ঝড়ে চার বিঘা জমিতে লাগানো পাট নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলেন। তবে পরে ফলন ‘মোটামুটি ভালোই’ হয়েছে। চার বিঘা জমি থেকে পাওয়া ৪০ মণ পাট এবার ভালো দামে বিক্রি করতে পারবেন বলেই তিনি আশা করছেন।
এ বছর দুই বিঘা জমিতে পাট চাষ করা টেংরা গ্রামের কৃষক মোহাম্মদ আলি মিলনও ভালো দাম পাওয়ার আশায় রয়েছেন।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হীরক কুমার সরকার বলেন, এবার উপজেলায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি জমিতে পাটের চাষ হয়েছে। নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা দুই হাজার ৬০০ হেক্টর জমির বিপরীতে চাষ হয়েছে পাঁচ হাজার ৬০০ হেক্টরে। গত বছর পাটের উপযুক্ত দাম পাওয়ায় এ মৌসুমে কৃষকরা পাটের আবাদ বেশি করেছেন।
তিনি আরো বলেন, ‘৬০০ নারীকে আমরা সরকারিভাবে প্রশিক্ষণ, বীজ, সার, কীটনাশক দিয়ে পাট চাষে সহায়তা করেছি তবে উপজেলায় দুই হাজার নারী নিজের জমিতে চাষাবাদ করেন। অন্যের জমিতে মজুর হিসেবে কাজ করেন আরো প্রায় চার হাজার নারী।
‘তবে মৌসুমে পাটকাঠি থেকে পাট ছাড়ানোর কাজ করেন এ জনপদের প্রায় ১৩ হাজার নারী।’