জেলা প্রতিনিধি, পাবনা: পাবনার অবহেলিত জনপদ ভাঙ্গুড়া উপজেলা। বিলঘেরা জনপদটির স্বাস্থ্য সেবা ছিল অবহেলিত। চরম দারিদ্র্যসীমায় বসবাস করা ভাঙ্গুড়ার মানুষের কাছে এমবিবিএস বা বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সেবা পাওয়া দুঃসাধ্য ব্যাপার। বাজারের কোন ফার্মেসি থেকে এক দুই পাতা ট্যাবলেটই ছিল ভাঙ্গুড়াবাসীর চিকিৎসা।
আরও পড়ুন: ডেঙ্গুতে একদিনে ৫ প্রাণহানি
একমাত্র ভরসা ছিল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। সেখানেও চিকিৎসা পেতে বেগ পেতে হতো। জরাজীর্ণ অবকাঠামো আর অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে সেখানে চিকিৎসা নিতে চাইতো না সাধারণ মানুষ।
কিন্তু এখন সেই পরিস্থিতি পাল্টিয়েছে। এখন খুব সহজেই ভাঙ্গুড়ার মানুষ উন্নত মানের চিকিৎসা সেবা পান। এখন আর পাবনা জেনারেল হাসপাতালে দৌঁড়াতে হয় না। শুধু সাধারণ মানুষ নয়, বিত্তশালীরাও এখন চিকিৎসা সেবা নেন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। উপজেলার চিকিৎসা সেবার এই আমুল পরিবর্তন ঘটিয়েছেন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মোছা. হালিমা খানম।
তিনি এখন ভাঙ্গুড়ার মানুষের চিকিৎসার ভরসাস্থল হয়ে উঠেছেন। শুধু ভাঙ্গুড়া নয়, ফরিদপুর ও চাটমোহরসহ আশপাশের থানা-উপজেলার মানুষও তার কাছে চিকিৎসা সেবা নিচ্ছেন। বিশেষ করে নারী ও প্রসূতি রোগের ক্ষেত্রে ডা. হালিমা খানম অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। মোট কথায় ভাঙ্গুড়ার মানুষের কাছে দোরগোড়ায় আধুনিক স্বাস্থ্য সেবার সুফল সরবরাহে বিপ্লব ঘটিয়েছে তিনি।
আরও পড়ুন: সরকারিতে ডেঙ্গু টেস্ট ফি ৫০ টাকা
সরেজমিনে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দেখা গেছে, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স যেন কোনও দর্শনীয় স্থান। আশপাশগুলো সাজানো হয়েছে দৃষ্টিনন্দনভাবে। প্রধান গেট পেরোলেই চোখে পড়বে ফুল বাগান। চারদিকে পরিস্কার-পরিচ্ছনতাই বলে দেয় এখানে চিকিৎসা সেবায় কতটা প্রধান্য দেয়া হয়।
পাবনার অন্যান্য উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে দুরগন্ধে ঢোকায় মুশকিল, শুধু উপজেলা নয় খোদ পাবনা জেনারেল হাসপাতালে যেন একটি ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। কিন্তু ভাঙ্গুড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভিন্ন চিত্র। প্রাথমিকভাবে দেখলে মনেই হবে না এটা হাসপাতাল, ধারণা করা হবে কোনও সরকারি বড় কোনও অফিস চত্তর।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অন্যান্য ডাক্তারের চেম্বারের সামনে দুই-একজন রোগী অপেক্ষা করছেন। কিন্তু উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মোছা. হালিমা খানমের চেম্বারের সামনে গেলে রোগীদের উপচে পড়া ভীড়। শুধু ভাঙ্গুড়া নয়, ফরিদপুর ও চাটমোহরসহ আশপাশ থেকে রোগীরা এসেছেন ডা. মোছা. হালিমা খানমের কাছে চিকিৎসা নিতে। কেই কেউ সকালে এসে বসে আসেন দুপুর পর্যন্ত, তবুও ডা. মোছা. হালিমা খানমের চিকিৎসা না নিয়ে ফিরবেন না।
আরও পড়ুন: দ্রুত ছড়াচ্ছে ডেঙ্গু
খোদেজা বেগম নামের এক প্রসুতি রোগীর সঙ্গে কথা হলো। তিনি এসেছেন পাবনার ফরিদপুর উপজেলা থেকে। তিনি বলেন, হালিমা ম্যাডামের কাছে চিকিৎসার নিতে ফরিদপুর থেকে এসেছি। এই ম্যাডাম অনেক ভালো ডাক্তার। আমাদের অনেক আত্মীয়-স্বজন চিকিৎসা নিয়েছে। তারা এই ম্যাডামের খুব প্রসংশা করে। আমিও এর আগে দুইবার এখানে চিকিৎসা নিয়েছি।
মুরসালিনা আক্তার নামের আরেক রোগী বলেন, আমি দুইটা সিজারিয়ান অপারেশন করেছি এই ম্যাডামের কাছে। আরেকটি সন্তান নেবো কিনা তার জন্য আজকে তার কাছে এসেছি। তিনি অত্যান্ত সুন্দর ব্যবহার করেন। যতো রাতই হোক তার কাছে গেলে চিকিৎসা না নিয়ে ফেরেন না। আমি নিজেই রাত ১২টার দিকে একদিন তার কাছে গিয়ে চিকিৎসা নিয়েছিলাম। তার ব্যবহার একজন মায়ের মতো।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার সহকারী হিসেবে ৪০ বছর ধরে চাকরি করছেন অফিস সহকারী মাহবুব হোসেন। তিনি বলেন, ৪০ বছরে আমি অনেক স্যার-ম্যাডামকে দেখেছি। কিন্তু ওনার মতো এমন রোগী দরদী ডাক্তার দেখিনি। প্রায় সব রোগীই ওনার কাছে আসেন। ওনার চিকিৎসা না নিয়ে একটি রোগীও বাড়ি ফিরতে চান না। ওনার ব্যবহারে সবাই খুশি।
আরও পড়ুন: চিকিৎসকরা মানবতার সৈনিক
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মোছা. হালিমা খানম বলেন, ২০১০ সালে আমি মেডিকেল অফিসার হিসেবে যোগদান করি। শুরু থেকেই আমি মানুষকে নিজের মতো করে সর্বোচ্চ চিকিৎসা সেবা দেয়ার চেষ্টা করি। ভাঙ্গুড়ার এই চিকিৎসা সেবার উন্নতির জন্য সবারই অবদান আছে। আমি যেন মৃত্যু পর্যন্ত মানুষকে এভাবে চিকিৎসা সেবা দিতে পারি সেই চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।
তিনি বলেন, মান সম্মত চিকিৎসা সেবা প্রদানের অভিজ্ঞতা এবং পদোন্নতির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আমি ২০১৭ সালে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছি। একাধিকবার আমি আমার নিজ উপজেলায় (ফরিদপুর) বদলি হয়ে যেতে চাইলেও ভাঙ্গুড়ার জনপ্রতিনিধি, গণমান্য ব্যক্তি, এমনকি সাধারণ মানুষের বারংবার অনুরোধে যেতে পারিনি। তারপরও আমি দুইবার বদলি হয়েছিলাম কিন্তু জনপ্রতিনিধি, গণমান্য ব্যক্তি, আর সাধারণ মানুষের অনুরোধে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছি।
সান নিউজ/এইচএন