ফিচার ডেস্ক: নারী শাসিত এক অভিনব সাম্রাজ্য সেখানে। সবকিছুতেই প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন নারীরা। আর সমাজে পুরুষরা গৌণ। এই সম্প্রদায়ের নাম মসু। যারা পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন মাতৃতান্ত্রিক এক সম্প্রদায়। দক্ষিণ-পশ্চিম চীনে হিমালয়ের ইউনান প্রদেশে পাহাড়ের তাদের অবস্থান।
পুরুষের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক ছাড়া যেহেতু সন্তান উৎপাদন সম্ভব নয়, তাই মসুও সমাজে পুরুষের প্রয়োজন ভবিষ্যৎ বংশধর তৈরির জন্য। এর বাইরে পুরুষের সাথে সম্পর্ককে তাদের সমাজে নিরুৎসাহিত করা হয়। মসুও জনগোষ্ঠীকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন পেশায় আইনজীবী চু ওয়াই হং।
তিনি ২০০৬ সাল পর্যন্ত কাজ করতেন সিঙ্গাপুরের একটি বড় প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ আইনজীবী হিসেবে। ওই বছর তার শহুরে ব্যস্ত জীবন থেকে আগাম অবসর নিয়ে চু ওয়াই হং যখন তার পূর্বপুরুষের দেশ চীনে বেড়াতে যান, তখন হঠাৎই তিনি দেখা পান পাহাড়ের বাসিন্দা এই বিচ্ছিন্ন সম্প্রদায়ের। সঙ্গে সঙ্গে তাদের দারুণ ভাল লেগে যায় চু ওয়াই হংয়ের।
খুব কাছ থেকে ওই সম্প্রদায়ের জীবন-যাপন পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ পেয়েছিলেন চু ওয়াং হং। তিনি জানান, নারীরা সেখানে দারুণ ক্ষমতাশীল। আপনি সেখানে গেলে দেখবেন এই সম্প্রদায়ের নারীদের মধ্যে কী পরিমাণ আত্মবিশ্বাস। আর এটা কিন্তু তাদের স্বভাবজাত।
আমাদের নারীদের মধ্যে এটা সচরাচর দেখা যায় না। এরা কিন্তু সেভাবে শিক্ষিত নয়, এরা কৃষক, কিন্তু আত্মবিশ্বাসে এরা যেন টগবগ করছে! এভাবেই তিনি ওই নারীপ্রধান সম্প্রদায়ের বর্ণনা করেন।
ওয়াই হং জানান, ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ লুগু হ্রদ লিজিয়াং শহরের কেন্দ্র থেকে বিস্তৃত ইউনান প্রদেশের নিংলাং এবং সিচুয়ান প্রদেশের ইয়ানইউয়ান-এর সীমান্তবর্তী এলাকা পর্যন্ত। পাহাড়ের প্রায় ৩ হাজার মিটার উচ্চতায় অপূর্ব সুন্দর হ্রদ লুগু লেক। এর চারপাশে চমৎকার ঝাউবন। পাহাড়ে ঘেরা চোখ জুড়ানো দারুণ এলাকা। প্রত্যেকেই কৃষিজীবী আর খুব শান্ত ধীরস্থির জীবনযাত্রা সেখানে।
সিঙ্গাপুরে ওয়াই হংয়ের কর্মজীবন ছিল খুবই সফল। কিন্তু তা ছিল অমানুষিক ব্যস্ততায় ভরা। রোজই প্রায় রাত বারোটা পর্যন্ত তাকে কাজ করতে হতো, প্রায়ই সপ্তাহে সাত দিন।
কয়েক দশক এভাবে চলার পর একদিন সকালে উঠে তিনি ঠিক করলেন, সাফল্য আর অর্থের বাইরে যে জীবন তাকে জানতে তিনি বেরিয়ে পড়বেন। কাজে ইস্তফা দিলেন।
চু ওয়াই হং যখন ২০০৬ সালে লুগু লেকে যান, তখনও সেখানে পর্যটকদের আনাগোনা প্রায় ছিলই না। বাইরের মানুষের প্রভাবও তেমন পড়েনি। তিনি তখনও ভাবেননি যে সেখানেই তিনি ভবিষ্যতে তার ঘর বাঁধবেন।
মসুও একটি ছোট প্রাচীন সম্প্রদায়। সংখ্যায় তারা ৪০ হাজারের মত। মূলত স্বনির্ভর জাতিগোষ্ঠী, কঠোর ধর্মবিশ্বাস আর সংস্কৃতি কেন্দ্রিক তাদের জীবনযাপন। মসুও নারীরা প্রকৃতির উপাসক। লুগু হ্রদকে তারা মায়ের মতো সম্মান করেন। এই হ্রদের তীরে তাদের বর্ণাঢ্য নৃত্য দেখার মতো।
ওয়াই হং যেদিন সেখানে গিয়ে পৌঁছান, সেদিন মসুও নারীরা তাদের প্রথাগত উজ্জ্বল সাজপোশাকে পাহাড়ের দেবীর উৎসব উদযাপন করছিলেন। তারা খুব মজা করে নাচ-গান করছিল, আগুন জ্বালিয়ে খাবার রান্না করছিল আর পর্বতের দেবীর সামনে ধূপ জ্বালাতে সবাই পাহাড় ভেঙে উপরে উঠছিল। পাহাড়ের মাথায় তাদের দেবী গামুর মন্দির।
তাদের বিশ্বাস এই দেবীই তাদের রক্ষাকর্ত্রী। তারা বলে, তাদের এই দেবী নাচ-গান ভালবাসেন, মদ্যপান, বহুগামিতা তার খুব পছন্দ। তাই এই দেবীকেই তারা অনুসরণ করেন। মসুও নারীদের বক্তব্য, দেবীর মতো তাদের জীবনেও একাধিক পুরুষসঙ্গী চাই। তারা একজনের সাথে আটকে থাকতে চান।
প্রথাগতভাবে মসুওরা মাতৃতান্ত্রিক। অর্থাৎ তাদের বংশ পরম্পরা মায়ের দিক থেকে। তাদের সমাজে মাতামহী বা প্রমাতামহী সবচেয়ে ক্ষমতাশালী। মেয়ে মায়ের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়।
মসুও পরিবারের কন্যারা ভাই বা ছেলের ভরনপোষণের দায়িত্ব নেয়। ছেলেরা কখনও বাসা ছেড়ে কোথাও যায় না। বোনের পরিবারেই থাকে। তবে ভবিষ্যত প্রজন্মে পরিবারের মাথা কে হবে, সেটা কোন কন্যাসন্তান পরিবারের অগ্রজ, সেটা বিচার করে তারা ঠিক করে না। পরিবারে যে কন্যা সন্তান সবচেয়ে বুদ্ধিমতী আর সবচেয়ে পরিশ্রমী সেই পরিবারের মাথা হয়।
মসুও পরিবারের মাথা হবেন কোন নারী তা ঠিক করে দেন পরিবারের মায়ের বংশের সবচেয়ে বয়ষ্ক নারী। মেধা ও কর্মদক্ষতা বিচার করে সেটা ঠিক করে দেন তিনি। পরিবারে সবাইকে তিনি নির্দেশ দিয়ে জানিয়ে দেন ভবিষ্যতে ওই পরিবার কার কর্তৃত্ব মেনে নেবে।
মসুওদের লোক সংস্কৃতিতে তাদের বিশ্বাস যে পুরুষের ভূমিকা হলো শুধুই সন্তান উৎপাদনে সাহায্য করা। কিন্তু শিশুর জীবনে বাবার আর কোন ভূমিকাই থাকে না। মসুও পরিবারে শিশুরা যেহেতু মায়ের বাড়িতে বেড়ে ওঠে, তাই ঘরে পুরুষ বলতে বাবার চেয়ে তারা বেশি চেনে মামাকে বা মায়ের বংশের যে পুরুষ সেই পরিবারে থাকেন তাকে।
আমরা বাবা বলতে যেটা বুঝি মসুও সমাজে বাবারা কিন্তু সেরকম নয়। সন্তানের বড় হয়ে ওঠার ব্যাপারে তাদের কোন দায়িত্বই থাকে না। সব দায়িত্ব নেন মামারা। বোনের বাচ্চাদের মসুও সংস্কৃতি সম্পর্কে শিক্ষা দেয়া, তাদের জীবনযাপন, মূল্যবোধ সবকিছু যথাযথভাবে শেখানোর দায়িত্ব মামাদের।
মসুও সমাজে পুরুষদের ভূমিকা খুবই গৌণ। তারা মসুও নারীদের সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী ভাবে বসবাস করেন না। মসুওদের সমাজে নারী পুরুষের সম্পর্কের ব্যাপারটাও একেবারেই অন্যরকম। বিয়ে বলে তাদের সমাজে কিছু নেই। নারী আর পুরুষের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্কেও তারা বিশ্বাস করে না।
মসুও সমাজে একজন পুরুষ নারীকে বলে- আজ রাতে আমি তোমার বাসায় কাটাব। মসুওদের বাসায় প্রত্যেক নারীর আলাদা ঘর থাকে। পুরুষ এসে রাতে তার পছন্দের নারীর দরজায় পাথর দিয়ে টোকা মারে ও তার ঘরে রাত কাটায়।
ওই পুরুষকে সূর্য ওঠার আগেই ঘর থেকে চলে যেতে হয় তার নিজের বাসায়। মসুওরা এটাকে বলে পথচলতি বিয়ে। তারা কখনই এই পথচলতি বিয়েকে স্থায়ী কোন সম্পর্ক হিসাবে দেখে না বা দেখার প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করে না। তাদের যুগল সম্পর্ক শুধু রাতের ওই মুহূর্তটির জন্যই স্থায়ী হয়।
চু ওয়াই হং মসুওদের গ্রামে গিয়ে বেশ কয়েকবার থাকার পর গ্রামের বাসিন্দারা তাকে পাকাপাকি ভাবে থেকে যাবার অনুরোধ জানান। তিনি বলেন, আমাকে সবচেয়ে মুগ্ধ করেছিল নারীদের প্রতি মসুওদের সম্মানবোধ। মসুও সমাজে পুরুষরা ছোটবেলা থেকেই নারীদের সম্মান করতে শেখে। নারীর প্রতি সম্মানবোধ নিয়ে তারা বেড়ে ওঠে।
পুরুষপ্রধান দুনিয়ায় পুরুষরা নারীদের প্রতি যেভাবে আচরণ করে, তাদের যে চোখে দেখে, মসুও সমাজ নারীপ্রধান হলেও নারীরা কিন্তু পুরুষদের একইভাবে দেখে না। তারা পুরুষের ওপর প্রভুত্ব করে না। পুরুষদের গালমন্দ করে না। তাদের প্রতি মসুও নারীরা খুবই মমতাশীল।
সাননিউজ/এএসএম