নিজস্ব প্রতিনিধি : রূপগঞ্জের প্রণিতা সরকার। ২০০৯ সালে চাকরি ছেড়ে বিসিক থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে একটি জামদানি কারখানা গড়ে তোলেন। বর্তমানে তার তৈরি শাড়ি দেশ-বিদেশে রফতানি হচ্ছে। তিনি তৈরি করেন ২২ থেকে ৪৫ হাজার টাকা দামের জামদানি শাড়ি। বসুন্ধরা মার্কেটে তার একটি শো রুম আছে। কমপক্ষে ২২ জন কর্মী এই জামদানি তৈরি কারখানায় কাজ করেন। বিদেশে রফতানিতে সহায়তা করতে সরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন সময়ে তাকে মেলার আয়োজন করে জামদানি প্রদর্শনী ও বিক্রির জন্য ব্যবস্থা করে দেয়া হয়েছে। তিনি ২০ লাখ টাকা দিয়ে এই ব্যবসা শুরু করেছিলেন। বর্তমানে তার বার্ষিক আয় প্রায় ২ কোটি টাকা।
রাজশাহীর গোদাগাড়ির নারায়নপুর গ্রামের আরেক নারী উদ্যোক্তা নাজমা খাতুন। মাত্র ২০ হাজার টাকা দিয়ে কন্যা কুসুমকলির নামে একটি জুতা তৈরির কারখানা শুরু করেন। প্যারামেডিকেলের চাকুরি ছেড়ে জুতা তৈরির জন্য ২০০৬ সালে বিসিক থেকে প্রশিক্ষণও নেন তিনি। আজ ১২ থেকে ১৩ কোটি টাকার বড় দু’টি কারখানার মালিক। প্রায় ৪০০ কর্মী কাজ করে তার সাভার ইপিজেড এলাকার রফতানিমুখী এই কারখানায়। মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে তিনি জুতা রফতানি করেন। একসময় তার করাখানায় বাটা’র জুতাও তৈরি করে দিতেন। এখন নিজেই দু’টি ব্র্যান্ডের জুতা তৈরির উদ্যোগ নিয়েছেন।
গাইবান্ধার রেজবিন হাফিজ বলেন, বিসিক থেকে ২০১২ সালে মাত্র সাড়ে তিন লাখ টাকা দিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। পিপলস ফুট ওয়্যার নামে তার আশুলিয়ার জিরাবো ও গাইবান্ধার বটতলায় জুতা তৈরির দু’টি কারখানা গড়ে তুলেছেন। এর একটিতে বর্তমানে ৭০ জন শ্রমিক কাজ করে। শিক্ষকতা ছেড়ে তিনি ব্যবসা শুরু করেন। বর্তমানে দেশে-বিদেশে প্রায় আড়াইশ’ নারী উদ্যোক্তাকে নিয়ে বিভিন্ন মেলার আয়োজনে নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন। তিনি বলেন, বিসিক নারী উদ্যোক্তা সৃষ্টি করতে যে উদ্যোগ নিয়েছে তাতে সারাদেশে নতুন নতুন নারী উদ্যোক্তা তৈরির পথ অনেক সহজ হয়েছে।
দেশের আর্থ সামাজিক উন্নয়নে নারী উদ্যোক্তাদের মূল ধারায় সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে আগামী ২০২১-২২ অর্থ বছরে বাজেটে প্রণোদনাসহ বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করেছে সরকার। কয়েকজন নারী উদ্যোক্তা নতুন অর্থ বছরের প্রস্তাবিত বাজেটকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, নারী উদ্যোক্তাদের সফলতায় দেশে বিপুল সংখ্যক কর্মসংস্থান হয়েছে এবং নতুনরা উৎসাহিত হচ্ছে।
আর্থ সামাজিক উন্নয়নে নারী উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ ও আর্থিক প্রণোদনাসহ বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থা (বিসিক)সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থা কাজ করছে।
বিসিক ৯ হাজার ৬শ’৫৫ জন নারী উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন ট্রেডে প্রশিক্ষণ দিয়ে বিশেষ সাবলম্বী করে তুলেছে। ২০২০-২১ অর্থ বছরে করোনাকালেও ৩০১ জন নারী উদ্যোক্তা বিসিক থেকে বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে নারী উদ্যোক্তা হিসেবে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখছে।
প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত নারী উদ্যোক্তা রেজমিন হাফিজ, প্রণিতা সরকার ও নাজমা খাতুন বাসসকে জানান, বিসিক নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য চলতি বছর ৫০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নারী উদ্যোক্তাদের বিশেষ অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তারা যাতে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশের আর্থ সামাজিক উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখতে পারে তার জন্য সরকার ৮০ লাখ টাকা পর্যন্ত করমুক্ত সীমা ধার্য করে দিয়েছে। এতে নারী উদ্যোক্তারা বিশেষভাবে উৎসাহিত হয়ে সমাজের উন্নয়নে কাজ করতে পারবে।
বিসিক চেয়ারম্যান মোশতাক হাসান বাসসকে জানান, আগামী ২০২১-২২ অর্থ বছরে বিসিক নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় আরো ১ শ’ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করবে। চলতি জুন মাসের মধ্যে ৫০ কোটি টাকা বিতরণ সম্পন্ন হবে।
তিনি বলেন, প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নারীদের আত্ম-কর্মসংস্থানের ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করে আগামী অর্থ বছরে নানা কর্মসূচি চালু করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। নারী উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ ও আর্থিক প্রণোদনাসহ বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থা। আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি বাস্তবায়ন ও ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনে ২ কোটি মানুষের কর্মসংস্থান ও ১ কোটি নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি করতে বিসিক কর্তৃপক্ষ স্বল্প মেয়াদী, মধ্যমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে নানা উদ্যোগ বাস্তবায়ন করছে। স্বল্প মেয়াদী কর্মসূচির আওতায় ১ লাখ তরুণ নারী উদ্যোক্তাকে বিজনেস ইনকিউবেশন সুবিধা দান করবে বিসিক।
তিনি বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে কর্মসংস্থান ব্যাংক কর্তৃক গৃহীত ‘বঙ্গবন্ধু যুব ঋণ’ কর্মসূচির আওতায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বেকার যুবদের ঋণ সহযোগিতা প্রদান করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) ও কর্মসংস্থান ব্যাংকের মধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। সমঝোতা স্মারকের আওতায় কর্মোদ্যোগ হিসেবে বিসিক হতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যুবদের (১৮-৩৫ বছর বয়সী) স্বল্পসুদে (৯ শতাংশ সরল সুদে) ২০ হাজার টাকা হতে শুরু করে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত জামানতবিহীন ঋণ প্রদান করা হচ্ছে। বিভিন্ন জেলায় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প মেলার আয়োজন এবং অনলাইন মার্কেটিংয়ের জন্য নিজস্ব প্লাটফর্ম তৈরি করছে বিসিক। তথ্য প্রযুক্তি ভিত্তিক আধুনিক ব্যবসা উন্নয়ন সেবাসমূহ প্রবর্তনের মাধ্যমে উদ্যোক্তাদের আরো উন্নত সেবা প্রদানের অংশ হিসাবে বিভিন্ন উদ্যোগ বাস্তবায়নে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোকেও কাজে লাগোনো হচ্ছে। চলতি জুন মাসের মধ্যে ৫০ কোটি টাকা বিতরণের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য শামসুন নাহার ভূঁইয়া এমপি বাসসকে বলেন, নারী উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন সহায়তা প্রদান করতে সরকারের উদ্যোগে গড়ে ওঠা জয়িতা ফাউন্ডেশন করোনাকালে নানা উদ্যোগ বাস্তবায়ন করছে। বিভিন্ন সুবিধাদিসহ নারী উদ্যোক্তাদের ব্যবসা পরিচালনায় ও পণ্য উৎপাদনে প্রয়োজনীয় জ্ঞান-দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করে এই ফাউন্ডেশন। ক্ষেত্র বিশেষে পুঁজির যোগান দিতে ঋণ সহায়তাও প্রদান করা হয়।
সরকার সামাজিক নিরাপত্তা সুরক্ষার কৌশল পত্র ২০১৮-এর আলোকে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সামাজিক নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনে এসব কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের নারী জনগোষ্ঠীকে উন্নয়নের মূল ধারায় সম্পৃক্ত করার নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
সান নিউজ/এসএম