ফিচার ডেস্ক: মানবসভ্যতায় এমন অনেক নারী আছে যারা ইতিহাস রঞ্জিত করেছেন তাদের কর্মের মাধ্যমে। কেউ সুনাম কুড়িয়েছেন। কেউবা বেঁচে আছেন তাদের কুকর্মের জন্যই। তেমনই এক নারী আইলিন অর্নোজ। যিনি পেশায় ছিলেন একজন যৌনকর্মী এবং তার নেশা ছিল পুরুষদের হত্যা করা।
১৯৮৯ থেকে ১৯৯০ সালের মধ্যে ৭ পুরুষকে হত্যা করে ওই দেশটিতে তুমুল আলোচনার সৃষ্টি করেন। সিরিয়াল কিলারদের মধ্যে আইলিন অন্যতম আলোচিত এক নাম।
যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় ২০০২ সালে এক নারীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। ১৯৭৬ সালে সেদেশের সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড পুনর্বহালের পর থেকে কোনো নারীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার ১০তম ঘটনা ছিল সেটি। শৈশব পার করার আগেই সিরিয়াল কিলার হয়ে উঠেন আইলিন।
জীবনের প্রারম্ভেই তিনি যৌনতার সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন। মাত্র ১১ বছর বয়সেই সিগারেটসহ অন্যান্য জিনিসের লোভ দেখিয়ে তার কাছে নানান কুৎসিত আবদার করে বসতো অন্যরা।
যখন আইলিনের বয়স মাত্র ১৩ বছর, তখন যৌন কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে জেল খাটার সময় জেলের ভেতরই ফাঁস দিয়ে মারা যান তার বাবা। সেই দুঃসহ সময়ে আইলিনার মা তাকে তার দাদা-দাদীর কাছে রেখে চলে যান। তার দাদী মারা গেলে দাদার কাছেও তিনি নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হন। তখন থেকেই পতিতাবৃত্তিতে জড়িত হয়ে পড়েন আইলিন।
শৈশবের এত দুঃসহ স্মৃতি মাথায় নিয়েও জীবনকে ভালোবাসার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। ২০ বছর বয়সে হিচহাইকিং করে ফ্লোরিডায় গিয়ে লুইস ফেল নামে এক বয়স্ক ব্যবসায়ীকে বিয়ে করে কিছুদিনের মধ্যেই স্থানীয় আইনি জটিলতায় জড়িয়ে পড়েন। দ্রুতই তিনি লুইসের বাড়ি ত্যাগ করে স্থানীয় একটি বারে কাজ নেন। সেখানেও আইলিনের সঙ্গে কাস্টমারদের প্রায়ই মারামারি লাগতো।
পরবর্তীতে লুইস স্ত্রীর বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ আনলে আইনি প্যাঁচে পড়েন আইলিন। সেখান থেকে তার জন্মস্থান মিশিগানে ফিরে যেতে বাধ্য হন তিনি। এ সময়ে আইলিনের ভাই (যার সঙ্গে তার অনৈতিক সম্পর্ক ছিল) ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
তবে তার রেখে যাওয়া জীবন বীমার ১০ হাজার ডলারের মালিক হন আইলিন। সেই টাকায় একটি অভিজাত গাড়ি কিনে ফেলেন আইলিন। যদিও কিছুদিনের মধ্যেই মাতাল হয়ে গাড়ি চালানোর সময় সেটি ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। টাকার ঝুলি শেষ হয়ে গেলে আইলিন আবারও ফ্লোরিডায় চলে যান এবং চুরির দায়ে জেল খাটেন কিছুদিন।
তবে তখনো তিনি সিরিয়াল কিলার হয়ে ওঠেননি। গ্রেফতার হওয়ার পর আইলিন তার হত্যাকাণ্ডগুলোর বিষয়ে নানা সময়ে সাংঘর্ষিক বক্তব্য দিয়েছেন। একবার তিনি বলেন, যাদেরকে তিনি হত্যা করেছেন, তাদের দ্বারা তিনি ধর্ষণের কিংবা ধর্ষণচেষ্টার শিকার হয়েছিলেন।
আরেকবার বলেন, নিতান্তই তার ছিনতাই কাজে বাঁধা দেওয়ায় ওইসব লোকেরা হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে।
তার হত্যাকাণ্ডের প্রথম বলি রিচার্ড ম্যালরি ছিলেন একজন ধর্ষণ মামলার আসামি। যিনি আইলিনের হাতে খুন হওয়ার কয়েক বছর আগে জেল থেকে ছাড়া পান। ১৯৮৯ এর শেষের দিকে একটি ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতির দোকানে কেনাকাটা করছিলেন রিচার্ড। যে সময় আইলিন তাকে সাতবার গুলি করে হত্যা করেন। হত্যার পর আইলিন ম্যালরির লাশটি জঙ্গলে লুকিয়ে রাখেন।
১৯৯০ এর মে মাসে চল্লিশোর্ধ ডেভিড স্পিয়ার্সকেও একাধিক গুলি করে হত্যা করেন আইলিন। পরবর্তীতে ডেভিডের লাশ উলঙ্গ অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। স্পিয়ার্সের লাশ উদ্ধারের এক সপ্তাহ যেতে না যেতেই পুলিশ সমবয়স্ক চার্লস কারস্ক্যাডন নামে আরেক ব্যক্তির গুলিবিদ্ধ লাশ রাস্তার পাশে খুঁজে পায়।
৩০ শে জুন ১৯৯৫ সালে গাড়ি চালিয়ে ফ্লোরিডা থেকে আর্কানসাস যাওয়ার পথে নিখোঁজ হন পিটার সিমস। প্রত্যক্ষদর্শীরা পুলিশকে জানায় যে ম্যুর(আইলিনের বান্ধবী) এবং আইলিনের মত দেখতে দুই নারীকে তারা পিটারের গাড়ি চালাতে দেখেছে।
এই সব অপকর্মে আইলিনের সঙ্গী ছিলেন ম্যুর নামে তার এক বান্ধবী। ফ্লোরিডার ভলাসিয়া কাউন্টিতে বাইকার বারে মারামারির ঘটনায় পুলিশ তাকে গ্রেফতার করার আগে আইলিন এবং ম্যুর আরও তিনজনকে হত্যা করেছিলেন। পরবর্তীতে ম্যুর আইলিনকে ছেড়ে পেনসিলভানিয়াতে চলে যান এবং পুলিশ সেখানে তাকে গ্রেফতার করে।
তবে নিজের বান্ধবীর কাছেই শেষমেষ প্রতারণার শিকার হন আইলিন। যদিও তাতে পুলিশের মুখ্য ভূমিকা ছিল। পুলিশের সাজানো ফোনালাপের মাধ্যমে ম্যুর আইলিনকে সব হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে বিস্তারিত জানাতে বললে আইলিন সব হত্যাকাণ্ড স্বীকার করে নিয়ে ঘটনাগুলো তার বান্ধবীকে বলতে লাগলেন। আর তাতেই আইলিনকে দোষী সাব্যস্ত করার সব প্রমাণাদি পুলিশের হাতে চলে যায়। যদিও ফোনালাপে আইলিন তার বান্ধবীকে এসব হত্যাকাণ্ডের পেছনের কাহিনী বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন।
রিচার্ড ম্যালরি হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত হয়ে আইলিন অর্নোজের বিচারকাজ শুরু হয় ১৯৯২ এর জানুয়ারি মাসে এবং দোষী সাব্যস্ত হয়ে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন। মাসখানেক পরে আরো তিনটি হত্যাকাণ্ডে তার মৃত্যুদণ্ড হয়। একই বছরের জুন মাসে চার্লস কারস্ক্যাডন হত্যাকাণ্ডেও তার একই সাজা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হতে বেশ কয়েক বছর সময় লেগে যায়।
মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার ১০ বছর পরেও আইলিন ফ্লোরিডার জেলে ফাঁসির হুকুম কার্যকর হওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন। সেই সময় চিকিৎসকেরা তার মানসিক বিকৃতি দেখে তাকে সাইকোপ্যাথ হিসেবে চিহ্নিত করেন। ২০০১ সালে তিনি কোর্টের কাছে আবেদন করেন যেন তার ফাঁসির রায় তাড়াতাড়ি কার্যকর করা হয়!
যদিও তার পক্ষের আইনজীবী এই আবেদনকে তার মক্কেলের পাগলামো বলে তাকে রক্ষা করতে চাইছিলেন কিন্তু আইলিন তাতেও রাজি ছিলেন না। ২০০২ সালে ৬ জুন আইলিনের সেই মনোবাসনা পূরণ হয়। সেদিন রাতে তাকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়।
মৃত্যুর আগে একটি সাক্ষাৎকারে আইলিন বলেছিলেন, ‘আমি সম্পূর্ণ সুস্থ মানুষ। আমি এমন একজন যে কি-না মানবজীবনকে প্রচণ্ডভাবে ঘৃণা করি, আর যদি পৃথিবীতে আবার ফিরে আসতে পারি; তাহলে আরও হত্যা করবো।’
সাননিউজ/এএসএম