ফিচার ডেস্ক: দেখতে পুরোদস্তুর বিদেশী। চেহারায় একটু মিল, কিন্তু তার স্বভাবচরিত্র বাঙালি নারীর মতো। সবসময়ই পরনে থাকতো শাড়ি। বিয়েও করেছেন এক বাঙালি যুবককে। এতেও খবরের শিরোনাম হওয়ার কথা নয়। কিন্তু তিনি যে কাজটি করেছেন, সেজন্য আজও আলোচিত।
‘সাবিত্রী দেবী’ হিসেবে পরিচিত এই নারীর আসল নাম ম্যাক্সিমিয়ানি জুলিয়া পোর্টাস। ইতিহাস তাকে মনে রেখেছে হিটলারের অন্ধ ভক্ত হিসেবে। নিজেকে ‘ধর্মচ্যুত আর্য’ বলে মনে করতেন সাবিত্রী। সমর্থন করতেন নাৎসিবাদকে।
শুধু তাই নয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে তিনি গুপ্তচর হিসেবেও কাজ করেন মিত্রপক্ষের বিরুদ্ধে।
কে এই সাবিত্রী দেবী?
নীল শাড়ি পরা সাবিত্রী দেবীর ছবি দেখলে তাকে দেখে মনে হবে তিনি একজন ভারতীয় হিন্দু নারী। কিন্তু আসলে তা নয়। তিনি একজন ইউরোপিয়ান। তার জন্ম ১৯০৫ সালে ফ্রান্সের লিয়ঁ-তে। তার মা ছিলেন ইংরেজ আর বাবা একজন গ্রিক-ইটালিয়ান।
রহস্যময়, প্রায়-বিস্মৃত এই নারী ছিলেন একজন আর্য-শ্রেষ্ঠত্ববাদী লেখিকা। তিনি মনে করতেন - হিটলার হচ্ছেন হিন্দুদের ভগবান বিষ্ণুর একজন অবতার। হিটলার নাকি পৃথিবীতে কলি যুগের অবসান ঘটাবেন।
সাবিত্রী দেবী একজন উগ্র গ্রিক জাতীয়তাবাদী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে ১৯২০এর দশকে। আর্য জাতির বর্তমান অবস্থা দেখতে তিনি ভারতে যান ১৯৩০ সালে। তখন তার মনে স্থির ধারণা হয় যে ভারতে বর্ণাশ্রমপ্রথা, এবং অন্য বর্ণে বিবাহ নিষিদ্ধ হওয়ায় সেখানে ‘আর্যদের বিশুদ্ধতা’ রক্ষা পেয়েছে।
ব্রাহ্মণকে বিয়ে করেন সাবিত্রী
১৯৩০ সালে কলকাতা শহরে সাবিত্রী দেবী একটি হিন্দু মিশনের হয়ে কাজ শুরু করেন। সেখানে দেবী হিন্দি ও বাংলা শেখেন এবং একজন ব্রাহ্মণকে বিয়েও করেন। মিশনের পরিচালক স্বামী সত্যানন্দও হিটলারভক্ত ছিলেন। এর পর তিনি নাৎসিবা এবং হিন্দুধর্মীয় উপকথাগুলো মিলিয়ে হিটলারকে একজন ‘অবতার’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
সাবিত্রী দেবী ভারতের বিভিন্ন জায়গায় ‘আর্য মূল্যবোধ’ বিষয়ে হিন্দি ও বাংলায় বক্তৃতা দিতিন। তাতে হিটলারের মাইন কাম্পফ বই থেকে উদ্ধৃতি দিতেন।
সাবিত্রী দেবী বলতেন, হিটলার জার্মানির নেতা হলেও যেহেতু তিনি ইউরাপ থেকে ইহুদিদের নির্মূল করে আর্য নৃগোষ্ঠীকে তার শ্রেষ্ঠত্বের আসনে বসাতে চেয়েছিলেন -তাই হিটলারকে তিনি তার নিজেরও নেতা বা ‘ফুয়েরার’ মনে করেন।
১৯৪৫ সালে হিটলারের পতন হওয়ার পর সাবিত্রীর মন ভেঙে যায়। তিনি ইউরোপে ফিরে এসে শুরু করলেন লেখালিখি। তার বিভিন্ন বই ‘লাইটিং এ্যান্ড দ্য সান’, ‘লং হুইস্কার্স’, ‘টু-লেগড গডেস’- এগুলোতে তার নাৎসি চিন্তাধারা বিধৃত হয়েছে। নাৎসি সমর্থক লিফলেট বিলি করায় তিনি ১৯৪৮ সালে অধিকৃত জার্মানিতে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের হাতে গ্রেফতার হন।
রহস্যময় যৌনজীবন
সাবিত্রীর যৌনজীবনও ছিল রহস্যময়। অসিত মুখার্জিকে তিনি বিয়ে করলেও তারা একই গোত্রের না হওয়ায় তাদের মধ্যে নাকি কোনো যৌনসম্পর্ক ছিল না। পরে নাৎসিদের অর্থসহায়তা দানকারী ফ্রঁসোয়া ডিওর নামে এক মহিলা দাবি করেছেন যে তিনি তার প্রেমিকা ছিলেন।
শেষ জীবনে বেশি ভাগ সময়ই সাবিত্রী দেবী ভারতের দিল্লিতে থাকতেন। ১৯৭৭ সালে স্বামী অসিতকৃষ্ণ মারা যান। সাবিত্রীও ভারতের পাট চুকিয়ে ফিরে যান ইউরোপে। কিছু দিন জার্মানির ব্যাভেরিয়ায় থাকার পরে ফিরে আসেন জন্মভূমি ফ্রান্সে। তত দিনে তিনি অথর্ব হয়ে পড়েছেন, প্রায় হারাতে বসেছেন দৃষ্টিশক্তি।
১৯৮২ সালে ৭৭ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে সাবিত্রী দেবী মারা যান। হিন্দু রীতি মেনে তার মরদেহ দাহ করা হয়। পরে তার চিতাভস্ম ভার্জিনিয়ায় আমেরিকান নাৎসি পার্টির দফতরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। নব্য নাৎসি নেতা রকওয়েলের সমাধির পাশেই সেই ভস্মকে সমাহিত করা হয়।
ভারতে তার সাবিত্রী দেবীর কথা প্রায় কেউই মনে রাখে নি। তবে তার লেখায় যে হিন্দু জাতীয়তাবাদী ভাবনা ফুটে উঠেছে - আজকের ভারতে ক্ষমতাসীন দল ভারতীয় জনতা পার্টির মূল দর্শন এটাই!
সাননিউজ/এএসএম