নিজস্ব প্রতিনিধি, ঝিনাইদহ : কেউ কাপড় কাটছেন, কেউ করছেন সেলাই,একেবারে নতুন সদস্যরা শিখছেন নকশী ফোঁড়। আবার কেউ বাড়িতে তৈরি করা নানা ডিজাইনের নকশী কাঁথা, নকশায় তৈরি থ্রিপিচ, নানা রঙ-বেরঙের পুঁতি বসিয়ে তৈরিকৃত সো-পিচ পরিচালকের নিকট জমা দিচ্ছেন।
আবার কেউ কেউ নতুন কাজের অর্ডার নিয়ে ফিরছেন বাড়িতে। আর এগুলো সব সামলিয়ে নিচ্ছেন পরিচালক একাই। তাকে সাহায্য করছেন কাটিং মাষ্টার। এভাবে ঝিনাইদহ কালীগঞ্জের পৌর মহিলা সমবায় সমিতির প্রায় ২ শতাধিক অসহায় নারী স্ব-কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে কাজ করছেন। মাত্র ৩ বছর আগে গঠিত এ সমিতির দৃশ্যমান কর্মকান্ড ইতোমধ্যে সকলের নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছে।
সমিতির সদস্যদের আশা খুব শীঘ্রই এ সংগঠনের প্রত্যেকে অর্জিত দক্ষতা কাজে লাগিয়েই হতে পারবেন স্বাবলম্বী। সমিতির সদস্যভুক্ত একাধিক অসহায় নারী জানান,তাদের সকলেরই অভাবের টানাটানির সংসার। অনেকে আছেন নানাবিধ কারনে নিজেই সংসারের একমাত্র উপার্জনকারী। আবার অনেকের স্বামী সংসার থাকলেও সাংসারিক কাজ শেষে বাড়িতে অলস সময় কাটিয়ে থাকেন।
বর্তমানে এ সমিতির সদস্য হয়ে নকশী কাঁথা সেলাই,দর্জির কাজ শেখা ছাড়াও কুটির ও হস্তশিল্পের অনেক কাজ শিখতে পারছেন। আবার কেউ কেউ অর্ডার মত থ্রিপিচ, পাঞ্জাবী, নকশী কাঁথায় নানা ডিজাইনের কাজ করে সমিতিতে জমা দিয়ে ন্যায্য মজুরী পাচ্ছেন। এভাবে উপার্জিত এ পয়সা দিয়েই চলছে তাদের সংসার।
তারা আরও জানান, সাধারন মানের একটি নকশী কাঁথা সেলাই করে কমপক্ষে সাড়ে ৫ থেকে ৬ হাজার টাকায় বিক্রি করতে পারেন। সৌখিন এ কাঁথা গুলো পরিবারে ব্যবহারের জন্য আবার কখনও আপনজনকে উপহার দিতে স্থানীয়রা আগে থেকে অর্ডারের মাধ্যমে তাদের কাছ থেকে তৈরি করছেন। তাছাড়াও তাদের তৈরিকৃত সৌখিন জিনিসপত্র ঢাকাসহ বাইরের বিভিন্ন শহর থেকে ক্রেতারা এসে নগদ টাকায় কিনে নিয়ে যাচ্ছেন।
বিনিময়ে সমিতিতে অল্প কিছু টাকা জমা দিয়ে বাকি কাজটি সংশ্লিষ্ট সদস্য পেয়ে যাচ্ছেন। তারা বলেন, তাদের মধ্যে অনেকে আছেন আগের থেকে নকশী কাপড় সেলাইয়ের কাজ করতেন। কিন্ত তৈরিকৃত কাপড় বিক্রি করতে পারতেন না। একটি নকশী করা পোশাক বা কাঁথা সেলাই করতে অনেক সময় লাগে। আগে সঠিক যোগাযোগের অভাবে এতো কষ্টের কাঁথা বিক্রি করতে সময় লেগে যেতো।
কিন্ত এখন সবাই মিলে কাজ করার কারনে বাইরের অর্ডার বেশি পাচ্ছেন। আবার অল্প সময়ের মধ্যে সেটা বিক্রিরও নিশ্চয়তা থাকছে। তাদের নকশী কাজে অভিজ্ঞ মাষ্টার ডিজাইন বুঝিয়ে দেন যে কারনে কাজগুলো হয় নিখুঁত ও আকর্ষনীয়। ফলে নিজ এলাকার পাশাপাশি বাইরের ক্রেতারাও এগুলো অধিক আগ্রহে কিনছেন। ফলে কাজ বেশি হওয়ায় এখন তাদের সারাবছরের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে।
মিতা বিশ্বাস নামের সমিতির এক সদস্য জানান, তিনি অনেক দিন ধরে নকশী কাঁথাসহ নানা নকশা করা পোশাক তৈরি করেন। সমিতির সদস্য হওয়ার পর সারাবছরই প্রায় কাজ থাকে। তিনি বলেন, আগে নিজে অর্ডার নিয়ে বাড়িতে কাজ করতেন। কিন্ত তৈরিকৃত পোশাক বিক্রি করতে অনেক সময় লেগে যেতো। এখন তা নেই। তিনি আরও বলেন, ব্যক্তিগত অর্ডার ছাড়াও বর্তমানে সমিতির পরিচালকেরা দর কষাকষির মাধমে কাজের অর্ডার নিয়ে কাটিং মাষ্টার নকশার ধরন বুঝিয়ে দেন। সে মোতাবেক বাড়িতে বসে কাজ শেষ করে সমিতিতে জমা দিলে মুজুরির টাকা পেয়ে যান। তিনি জানান, সমিতির পক্ষ থেকে জিনিসপত্রের অর্ডার ধরে পরে তার মত অনেকের মাঝে ভাগ করে দেওয়া হয়।
আলোমতি দাস নামের অন্য এক সদস্য জানান, তার স্বামীর সংসার সবই আছে। স্বামী কাঠমিস্ত্রির কাজ করেন। তবে সব সময় তার কাজ থাকে না। ফলে অভাবের সংসার তার। নিজে বাড়িতে বসে না থেকে কাজ করে পয়সা রোজগারের মাধ্যমে সংসারে সাহায্য করছেন। তার দুটি সন্তান লেখাপড়া করে। তাদের লেখাপড়ার খরচ যোগানোর ক্ষেত্রেও বর্তমানে ভূমিকা রাখতে পারছেন।
সমিতির পরিচালক মিনা ভট্রাচার্য্য জানান, এখানে তার নিজের কোন অর্জন নেই। সবকিছুই সদস্যরাই করে থাকেন। নিজে একজন মহিলা মাষ্টার দিয়ে সপ্তাহে একদিন বিভিন্ন হাতের কাজের প্রশিক্ষন দিয়ে যাচ্ছেন। আবার অনেকে আছেন সুন্দর সুন্দর নকশী কাজে পারদর্শী। তাদের তৈরিকৃত জিনিসগুলো বাইরের ক্রেতাদের নিকট ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করে থাকেন।
কোন ক্রেডিট প্রোগ্রাম নেই। প্রতি সপ্তাহে তাদের নিকট থেকে মাত্র ১০ টাকা করে নেয়া হয়। এ দিয়ে চলে সমিতির অন্যান্য ব্যয়। প্রশিক্ষকের বেতনও হয় এখান থেকে।
এ সমিতির প্রধান উপদেষ্টা মোচিক শ্রমিক সমবায় সমিতির সাধারন সম্পাদক গোলাম রসুল জানান, মহিলাদের নিয়ে গঠিত এ সমিতির সদস্যরা যারা আছেন তারা বেশির ভাগই হতদরিদ্র। তাদেরকে সংগঠিত করে কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, সবকিছুই তারা করছেন তিনি শুধু পথ দেখিযে দিচ্ছেন মাত্র। এ সমিতিতে কোন ক্রেডিট প্রগাম নেই। কিন্ত তাদেরকে এক হিসেবে বিনা টাকায় সেলাইসহ হস্তশিল্পের বিভিন্ন কাজের প্রশিক্ষন দিচ্ছেন। যা অসহায় গরীব মহিলাদের জন্য একটা বড় কিছু।
সান নিউজ/শিপলু/এসএ