গাইবান্ধা প্রতিনিধি: কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। দেশে শিল্প-বাণিজ্য ক্ষেত্রেও বেড়েছে উদ্যোক্তা হিসেবে নারীর উপস্থিতি। ব্যবসায় পরিচালনার সিদ্ধান্ত থেকে শুরু করে সব কার্যনির্বাহের দায়িত্বে রয়েছেন নারীরা।
আরও পড়ুন: ব্রহ্মপুত্র নদ যেন মরা কঙ্কাল!
ব্যবসায় নারীদের উপস্থিতিতে একদিকে যেমন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, অন্যদিকে তাদের ব্যবসায়িক উদ্যোগগুলো দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরির মাধ্যমে সমাজে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। গাইবান্ধার শহর ছাড়িয়ে গ্রামগুলোতেও নারীরা ছোট অঙ্কের ঋণ নিয়ে উদ্যোক্তা হচ্ছেন।
তবে একজন নারীর উদ্যোক্তা হয়ে উঠা সহজ নয়। অনেক বাধা পেরিয়ে আসতে হয় তাদের। অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সবদিক থেকে বাধার মুখে পড়েন আমোদের দেশের নারীরা।
তবুও উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে দৃঢ়প্রত্যয় নিয়ে অনেকেই সামনে এগিয়ে যান। সেসব সাহসী নারীই হয়ে উঠেন সফল উদ্যোক্তা। তেমনি একজন সফল উদ্যোক্তা পিপলস ফুটওয়্যার এ্যান্ড লেদার গুডসের স্বত্বাধিকারী রেজবিন বেগম। তিনি চামড়াজাত সামগ্রী তৈরিতে সাফল্য অর্জন করেছেন।
আরও পড়ুন: কাল রাজধানীতে সমাবেশ করবে আ’লীগ
চামড়াজাত পণ্য উৎপাদনে সাফল্যের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন জাতীয় এসএমই বিজনেস ফোরাম অ্যাওয়ার্ড-২০২০। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে সেবারের বর্ষসেরা পুরস্কারটি তিনি জীবনের বড় স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন।
এছাড়াও তিনি ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলা-২০২০-এ সেরা নারী উদ্যোক্তা এবং ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলা-২০২২ ও ২০২৩-এ দ্বিতীয় সেরা নারী উদ্যোক্তার গৌরব অর্জন করেন।
প্রায় একযুগের কঠোর পরিশ্রম আর প্রচেষ্টা তাকে এ সফলতা অর্জনে সহায়তা করেছে। একইসঙ্গে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছেন ২ শতাধিক মানুষের। এ যাত্রাপথে সহযাত্রী ও পথপ্রদর্শক হিসেবে আছেন তার জীবন সঙ্গী হাফিজুর রহমান।
আরও পড়ুন: ৪র্থ দফায় শহিদ বুদ্ধিজীবীর তালিকা প্রকাশ
গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার কাতলামারীর খাঁপাড়া গ্রামে রেজবিন বেগমের জন্ম। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। রেজবিন গাইবান্ধা সরকারি কলেজ থেকে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে ২০০২ সালে স্নাতক (সম্মান) এবং ২০০৩ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
২০১১ সালে স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ এবং ২০১৯ সালে ইস্ট-ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেদার ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের উপর পোস্টগ্রাজুয়েট ডিপ্লোমা সম্পন্ন করেন। বিয়ের পর থেকেই স্বামী হাফিজুর রহমানকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকায় বসবাস তার।
রেজবিন ২০০৭ থেকে ১ জুলাই থেকে ২০০৯ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত বেপজা পাবলিক স্কুল এ্যান্ড কলেজ এবং ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত মাইলস্টোন স্কুল এ্যান্ড কলেজে শিক্ষকতা করেন।
আরও পড়ুন: এবার রাজধানীর কড়াইল বস্তিতে আগুন
এছাড়া তিনি এসএমই ফাউন্ডেশন, স্কিটি, বিএসসিআইসি, আইএলও, বিআইডিএ প্রজেক্ট গাইবান্ধায় রিসোর্স পার্সন ও প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি নারী।
দেশের সার্বিক উন্নয়নে নারীর অবদান কোনো অংশে কম নয় উল্লেখ করে রেজবিন বলেন, এ উন্নয়নে নারীদের অবদান থাকলেও ব্যবসা-বাণিজ্য এবং কর্মক্ষেত্রে নারীরা এখনো পিছিয়ে আছেন। নারী উদ্যোক্তাবান্ধব পরিবেশ তৈরিতে শক্তিশালী ব্যবসায়িক যোগাযোগ, কার্যকর সহায়তা ব্যবস্থা, সৃজনশীলতা, উদ্ভাবন ও প্রশিক্ষণের বিকল্প নেই।
সরকার নারী উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ শর্তে ও কম সুদে ঋণ প্রদানের নীতিমালা প্রণয়ন করলেও এ সুবিধা পাচ্ছেন না নারী উদ্যোক্তারা। নানা শর্তের বেড়াজালে ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে ভোগান্তিতে পড়ছেন তারা।
আরও পড়ুন: হত্যার দায়ে ৩ জনের যাবজ্জীবন
ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যে পিছিয়ে যাচ্ছেন নারীরা। ব্যাংক ঋণের ক্ষেত্রে বিদ্যমান নীতিমালা আরও সহজীকরণের মাধ্যমে তার কার্যকর বাস্তবায়ন করে নারী উদ্যোক্তাদের সংকট নিরসনের উদ্যোগ জরুরি বলে মনে করেন এ নারী উদ্যোক্তা।
তিনি আরও জানান, প্রকৌশলী হাফিজুর রহমানের অনুপ্রেরণায় একজন উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার সংগ্রাম শুরু করেন রেজবিন। চামড়াজাত সামগ্রী তৈরির পরিকল্পনা নিয়ে রাজধানীর ধামরাইয়ে কালামপুর বিসিক শিল্পনগরীতে গড়ে তোলেন পিপলস লেদার ইন্ডাস্ট্রিজ।
ভ্যানিটি ব্যাগ ও বেল্টসহ নানা পণ্য উৎপাদন এবং বাজারজাতকরণ শুরু করেন। প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে উৎপাদিত পণ্যের মান নিশ্চিত করতে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেন তিনি।
আরও পড়ুন: ভুটানের রাজা ঢাকায় আসছেন কাল
নিজ জেলা গাইবান্ধার অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে বিসিক শিল্পনগরী এবং গাইবান্ধায় প্রতিষ্ঠা করছেন পিপলস ফুটওয়্যার এ্যান্ড লেদার গুডস নামের শিল্পপ্রতিষ্ঠান। এছাড়া চামড়াজাত শিল্পের কর্মীদের দক্ষতা উন্নয়নে ঢাকার উত্তরায় প্রতিষ্ঠিত পিপলস ফুটওয়্যার এ্যান্ড লেদার ট্রেনিং সেন্টারের পরিচালক তিনি।
রেজবিন এসএমই ফাউন্ডেশনের জেনারেল বোর্ড মেম্বর, বিসিক উদ্যোক্তা ফোরামের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং বিসিক এসইআরডবিউটিআইসি ট্রাস্টের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
উদ্যোক্তা রেজবিন জানান, ২০১২ সালে উত্তরা মাইলস্টোন কলেজে শিক্ষকতার পাশাপাশি পিপলস নাইফ ইঞ্জিনিয়ারিং নামে চামড়া খাতে ব্যবহৃত ডাইসের (কাটিং নাইফ) কারখানা গড়ে তোলেন তিনি।
যখন দেখেন তার কাটিং নাইফ দিয়ে জুতা তৈরী হচ্ছে, তখন শিক্ষকতার চাকরি ছেড়ে ২০১৪ সালে ২ জন কর্মী নিয়ে জুতা তৈরির কাজে হাত দেন রেজবিন। তখন পুঁজি ছিল সাড়ে ৩ লক্ষ টাকা। জুতা, ব্যাগ ও বেল্টসহ চামড়াজাত পণ্য তৈরি করার জন্য আশুলিয়ায় একটি ঘর ভাড়া নিয়ে পিপলস ফুটওয়্যার এ্যান্ড লেদার গুডস নামের কারখানা গড়ে তোলেন।
আরও পড়ুন: তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা থাকবে না
কিছুদিনের মধ্যেই জনপ্রিয় হয়ে উঠে তার প্রতিষ্ঠানের জুতা। বাড়তে থাকে পাইকারি ক্রেতার চাহিদাও। তার প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে ২০০ জন কর্মী কাজ করছে। যেখানে প্রতি মাসে উৎপাদন হয় ১২-১৩ হাজার চামড়াজাত পণ্য, যার ৭০ শতাংশই জুতা।
দেশের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের অর্ডার নিয়ে পণ্য তৈরির পাশাপাশি রেজবিনের প্রতিষ্ঠানে তৈরি পণ্য রফতানি হয় চায়না, মালয়েশিয়া, জাপান ও ভারতে।
নারী উদ্যোক্তাদের ব্যবসা করার ক্ষেত্রে প্রধান বাধার বিষয়ে তিনি বলেন, নারী উদ্যোক্তাদের কয়েকটি বাধা রয়েছে। এর মধ্যে প্রশিক্ষণ অন্যতম। তাদের হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। এটা না হলে ব্যবসা শুরুর পর নানা ধরনের সমস্যায় পড়তে হয়। সঙ্গে আছে সামাজিক বাধা।
যদিও এটা আগের চেয়ে অনেক কমেছে। পারিবারিক ও সামাজিকভাবে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়েছে। তবে একজন নারী ব্যবসা করতে পারবে কিনা, সে বিষয়ে পরিবার ও সমাজের সহযোগিতা আরও বেশি প্রয়োজন। নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ সুবিধা দিতে হবে। তা হলে নারীরা ব্যবসা-বাণিজ্যে আরও উৎসাহিত হবেন।
সান নিউজ/এনজে