নিজস্ব প্রতিবেদক:
খুলনা: বাংলাদেশের সোনালী আঁশ হিসেবে পাট সারা বিশ্বে পরিচিতি লাভ করেছে। তবে বেশ কয়েক বছর হল এদেশের পাটশিল্প ধ্বংসের মুখে। সম্প্রতি দেশে বন্ধ হয়ে গেল রাষ্ট্রয়াত্ব সকল পাটকল। কিন্তু তাতে তো আর কৃষকরা পাট চাষ থামিয়ে রাখেননি। এ বছরও দেশে বিপুল পরিমাণ পাটের উৎপাদন হয়েছে। কিন্তু যথাযথ ব্যবস্থাপনার অভাবে এবার ক্ষতির মুখে পড়তে হতে পারে কৃষকদের।
তাই রপ্তানি বাড়াতে কাঁচাপাট রপ্তানিতে শুল্ক আরোপ না করা, ক্ষতিগ্রস্ত পাট ব্যবসায়ীদের প্রণোদনা ও রপ্তানির বিপরীতে সাবসিডি দেওয়ার দাবি জানিয়েছে কাঁচাপাট রপ্তানিকারকের সংগঠন বাংলাদেশ জুট অ্যাসোসিয়েশন (বিজেএ)।
রোববার (৩০ আগস্ট) দুপুরে খুলনা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানানো হয়। সংগঠনের সভাপতি শেখ সৈয়দ আলী ও খুলনা সিটি করপোরেশনের মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক সংবাদ সম্মেলনে অংশ নেন।
তারা পাট রপ্তানির অতীত ও বর্তমান তুলে ধরেন। তাদের ভাষ্যমতে, ১৯৮৪-৮৫ সালে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ২৮-৩০ লাখ বেল কাঁচাপাট রপ্তানি হতো। কিন্তু ভ্রান্ত ধারণায় বিভিন্ন সময়ে কাঁচাপাট রপ্তানি বন্ধ হওয়ায় রপ্তানি সংকুচিত হয়ে বর্তমানে তা ৮-৯ লাখ বেলে দাঁড়িয়েছে। অথচ গত সপ্তাহে পাট মন্ত্রনালয়ের সঙ্গে আলোচনা সভায় বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশন ভুল তথ্যের ভিত্তিতে সংকট দেখিয়ে কাঁচাপাট রপ্তানি প্রতি মণে ৮০০ টাকা হারে রপ্তানি শুল্ক আরোপের দাবি জানিয়েছে।
বিজেএ’র সভাপতি শেখ সৈয়দ আলী বলেন, দেশে পর্যাপ্ত কাঁচাপাট রয়েছে। সরকারি পাটকলগুলো বন্ধ হওয়ায় সেই পাটও বাজারে এসেছে। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, রপ্তানি শুল্ক আরোপ করা হলে কাঁচাপাট রপ্তানি আবারো মুখ থুবড়ে পড়বে। এতে বাজারে পাটের দাম কমে যাবে এবং চাষি ও রপ্তানিকারকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তাই সংবাদ সম্মেলনে ক্ষতিগ্রস্ত কাঁচা পাট রপ্তানি খাতে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত আর্থিক প্রণোদনা সুবিধা ও রপ্তানির বিপরীতে সাবসিডি পেতে সংশ্লিষ্ঠ মন্ত্রণালয়ের প্রতি ভূমিকা রাখার আহবান জানান তিনি।
লিখিত বক্তব্যে শেখ সৈয়দ আলী অভিযোগ করে বলেন, ‘রপ্তানি বাণিজ্যে নিয়োজিত শত বছরের ঐতিহ্যবাহী কাঁচাপাট রপ্তানিকারকরা কাঁচা পাট রপ্তানির মাধ্যমে শতভাগ বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছেন। কিন্তু রপ্তানি শুল্ক আরোপ করে সেই কাঁচা পাট রপ্তানি খাতকে ব্যাহত করার অপচেষ্টা চলছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘১৯৮৪ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ভুল তথ্যের ভিত্তিতে কাঁচাপাট রপ্তানি বন্ধ করায় আমরা অর্থনৈতিকভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি, পর্যায়ক্রমে ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে উপনীত হয়েছি। শতাধিক ব্যবসায়ী এই ক্ষতি কাটিয়ে আজও ব্যবসায় ফিরতে পারেননি। এরপর বিশ্বব্যাপী করােনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে কাঁচাপাট রপ্তানি কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ায় আমরা আবারও ব্যপক ক্ষতিগ্রস্ত হই।’
বিজেএ’র আশঙ্কা, কাঁচা পাট রপ্তানি বন্ধ হলে পাটের বাজারে ধ্বস নামবে এবং কোটি কোটি কৃষক পাটের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হয়ে আগামীতে পাট চাষে উৎসাহ হারাবেন। এছাড়া কাঁচা পাট রপ্তানিতে সম্পৃক্ত খুলনা, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ, উত্তরবঙ্গসহ সারা দেশের লক্ষাধিক শ্রমিক-কর্মচারী বেকার হয়ে পড়বেন। আর দেশের ব্যবসার ধারাবাহিকতা নষ্ট হওয়ায় বর্তমানে যেটুকু কাঁচা পাটের আন্তর্জাতিক বাজার আছে, তাও আর থাকবে না।
সৈয়দ আলী বলেন, ‘চলতি অর্থবছরে সরকারি পাট অধিদপ্তরের তথ্যানুসারে এ বছর দেশে ৯২.৩৮ লাখ বেল পাট উৎপাদিত হতে পারে বলে প্রথমে প্রকাশ করা হয়। পরবর্তীতে বন্যার কারণে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৮৪.১৪ লাখ বেল। দেশের অভ্যন্তরীণ কাঁচা পাটের চাহিদা প্রায় ৫৫ লাখ বেল (সরকারি জুটমিলগুলোর চাহিদা প্রায় ১৩ লাখ বেল এবং বেসরকারি জুট ও স্পিনিং মিলগুলোর চাহিদা প্রায় ৪২ লাখ বেল)। কিন্তু সরকারি জুটমিলগুলো বন্ধের কারণে তাদের প্রায় ১৩ লাখ বেল পাটের চাহিদা থাকছে না। ফলে দেশের অভ্যন্তরীণ কাঁচা পাটের চাহিদা এখন সর্বোচ্চ ৪৫ লাখ বেল।’
‘বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সরকারি জুটমিলগুলো তাদের মজুদকৃত বিপুল পুরনো কাঁচাপাট তাদের নিজস্ব সরবরাহকারীদের পাওনা টাকার পরিবর্তে ফেরত দেওয়ায় সেই পাটও বাজারে চলে আসবে। এর ফলে এ বছর প্রায় ৪০ লাখ বেল কাঁচাপাট উদ্বৃত্ত থেকে যাবে। উদ্বৃত্ত পাট থেকে আমরা প্রতি বছর মাত্র ৮-৯ লাখ বেল কাঁচাপাট বিদেশে রপ্তানি করে থাকি।’
তিনি আরো বলেন, ‘ইচ্ছা করলেও বৈদেশিক ক্রেতার অভাবে আমরা এখন অতিরিক্ত পাট রপ্তানি করতে পারবো না। প্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে পাটের উৎপাদনও এখন অনেক বেড়েছে। তাই উদ্বৃত্ত পাট ব্যবহারের জায়গা বের করতে না পারলে বেশি পাট উৎপাদনের সুফল আমরা পাবো না। তাই কাঁচাপাট রপ্তানি সচল রাখার মাধ্যমে কাঁচা পাটের আন্তর্জাতিক বাজার ধরে রাখা এবং আন্তর্জাতিক বাজার সম্প্রসারণে উদ্যোগ প্রয়োজন।’
‘কিন্তু দুঃখের বিষয় বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স অ্যাসােসিয়েশন ভুল তথ্যের মাধ্যমে দেশে পাটের সংকট দেখিয়ে কাঁচাপাট রপ্তানির ওপর ২৫০ মার্কিন ডলার অর্থাৎ প্রতি মণ পাটে ৮০০ টাকার বেশি রপ্তানি শুল্ক আরোপের জন্য বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাব করছে এবং কাঁচাপাট রপ্তানি বন্ধের অপচেষ্টা চালাচ্ছে।’
এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বিজেএ’র এই নেতা কাঁচাপাট রপ্তানিতে শুল্ক মুক্তির দাবি জানান।
সান নিউজ/ এআর