মো. নাজির হোসেন, মুন্সীগঞ্জ: আলু উৎপাদনে বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ জেলা মুন্সীগঞ্জ। প্রতি মৌসুমে বিপুল পরিমাণ আলু উৎপাদনের রেকর্ড রয়েছে এ জেলার।
আরও পড়ুন: মাছ ও ডিমের বাজার চড়া
স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে জাতীয় পর্যায়ে আলুর চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন এ জেলার আলু চাষিরা। অন্যান্য বছর বর্ষা মৌসুমে আলুর দাম ক্রেতাদের হাতের নাগালে থাকলেও, এ বছর লাগামহীনভাবে বাড়ছে। খুচরা বাজারে কেজিতে ৪৫-৫০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে।
ক্রেতা, ব্যবসায়ী ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হিমাগারে চাহিদার তুলনায় আলুর মজুদ এখনো অনেক বেশি। এরপরও ব্যবসায়ীরা আলুর কৃত্রিম সংকট তৈরি করছেন।
আরও পড়ুন: বিকেলে বিএনপি ও সমমনাদের গণমিছিল
দাম বাড়িয়ে নিজেরাই হিমাগারে রাখা আলুর দলিল একজন অপরজনের সাথে বেচাবিক্রি করছেন। হাত বদলে প্রতিবার বাড়ানো হচ্ছে দাম। যার প্রভাব পড়েছে খুচরা ও পাইকারী বাজারে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, জেলায় এ বছর ভোক্তাদের মোট আলুর চাহিদা রয়েছে ৯৫ হাজার ৮৮ মেট্রিকটন। সেখানে উৎপাদন হয়েছে ১০ লাখ ৫৬ হাজার ৪৬৩ মেট্রিকটন। জেলার হিমাগার গুলোতে এখনো পর্যন্ত মজুদ রয়েছে ২ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিকটন আলু।
আরও পড়ুন: দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে নির্বাচন নিয়ে কথা হয়নি
জাতীয় পর্যায়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরে আলুর উৎপাদন ছিল ১ কোটি ১১ লাখ ৯১ হাজার ৫০০ মেট্রিকটন। দেশে আলুর চাহিদা ৮৯ লাখ ৯২ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৯১ লাখ ৯ হাজার মেট্রিকটন। সে হিসাবে, উদ্বৃত্ত থাকে অন্তত ২০ লাখ টনের বেশি আলু।
জেলা কৃষি বিপণন কর্মকর্তা এবি এম মিজানুল হক বলেন, গত বছর আলু উৎপাদন কিছুটা কম ছিল। তবে মুন্সীগঞ্জে আলুর কোনো সংকট নেই। এখনো যে পরিমাণ আলু হিমাগারে মজুদ আছে, তা চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি।
আরও পড়ুন: আজ আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশ
জাতীয় পর্যায়েও একই অবস্থা। পুরনো আলু শেষ হওয়ার আগেই নতুন আলু চলে আসবে। আলু ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে বাজারে অস্থিতিশীল অবস্থা তৈরি করেছে।
মুন্সীগঞ্জ বড় বাজার ও দেওভোগ বাজারের সবজির দোকানগুলোতে ঘুরে দেখা যায়, আলুর আকারভেদে ৪৫-৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছেন খুচরা ব্যবসায়ীরা। আলুর দাম বেশি হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করছেন ক্রেতারা।
আরও পড়ুন: বাড়তে পারে তাপমাত্রা
জাকির হোসেন নামে এক ক্রেতা বলেন, সব সবজির দাম নাগালের বাহিরে। একমাত্র আলুই ছিল গরীব ও মধ্যবিত্তের প্রধান সবজি। সেটিও সিন্ডিকেট করে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। ১৮-২০ টাকার আলু ৪৫-৫০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি চলতে থাকলে সাধারণ মানুষকে না খেয়ে মরতে হবে।
বাজারের খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত কয়েকদিন ধরে হিমাগারগুলোতে আলু সংকট দেখাচ্ছেন আলু ব্যবসায়ীরা। দুই সপ্তাহ আগে যে আলু ৩০-৩২ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেছি, সে আলুই আমাদের ২ দিন ধরে ৩০-৩৫ টাকা দরে কিনতে হচ্ছে।
আরও পড়ুন: মাদকবিরোধী অভিযানে গ্রেফতার ৩৯
এর সঙ্গে অন্যান্য খরচ রয়েছে আরও এক থেকে দেড় টাকা। তাই বাধ্য হয়ে ৪৫-৫০ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি করতে হচ্ছে। হিমাগার পর্যায়ে দাম নিয়ন্ত্রণ করা গেলে খুচরা পর্যায়েও দাম কমে যাবে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মুন্সীগঞ্জে ৬২ টি হিমাগার রয়েছে। যেখানে প্রতি বছর ৫ লাখ ৪৫ হাজার ৪৬০ মেট্রিকটন আলু রাখা হয়। মুন্সীগঞ্জের স্থানীয় আলুর পাশাপাশি রংপুর থেকে এনে রাখা হয়।
আরও পড়ুন: বায়ুদূষণে আজ ঢাকা অষ্টম
এসব আলু ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, সিলেট, বরিশাল, বরগুনা, চট্টগ্রামের বিভিন্ন আড়তে বিক্রি হয়। মৌসুমের শুরুতে হিমাগারগুলোতে ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি কৃষকরা আলু রাখলেও জুলাইয়ের আগে কৃষকের এসব আলু কিনে নেন ব্যবসায়ীরা। এরপরই আলুর বাজার ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে থাকে।
সরেজমিনে মুন্সীগঞ্জের টঙ্গীবাড়ি উপজেলার সানোয়ারা কোল্ড স্টোরেজ, নুর কোল্ড স্টোরেজে, সদর উপজেলার বিক্রমপুর মাল্টি পারপাস ও রিভারভিউ কোল্ড স্টোরেজের দেখা যায়, ব্যবসায়ীদের সঙ্গে অন্য ব্যবসায়ীরা দরদাম করে আলু কিনছেন।
শ্রমিকরা বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে কেউ আলু বাছাই করছেন, কেউ আলু বস্তা ভর্তি করছেন, আলু ওজন করে বিভিন্ন জেলায়, আড়তে পাঠাতে ট্রাক ভর্তি করছেন।
আরও পড়ুন: উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী
এ সময় হিমাগারে কয়েকজন শ্রমিক বলেন, বছরের এ সময় হিমাগারে ব্যস্ততা এমনই থাকে। আলুর বিক্রির পরিমাণ গত বছরের মতই। তবে দাম খুব চড়া। এক সপ্তাহে কেজিতে দাম বেড়েছে ৮-১০ টাকা। কেন বেড়েছে জানতে চাইলে শ্রমিকরা কোনো কথা বলতে চাননি।
আলুর দাম নিয়ে কথা বলতে নারাজ ব্যবসায়ীরাও। বর্তমানে জিনিসপত্রের দামের সঙ্গে আলুর এমন দাম যৌক্তিক বলে মনে করছেন তারা।
আরও পড়ুন: মেঘনায় ভাসছিল অজ্ঞাত ব্যক্তির মরদেহ
আলু ব্যবসায়ী হাজী সৈয়দ দেওয়ান বলেন, দেশে সব তরকারির দাম আকাশ ছোঁয়া। অন্য তরকারির উৎপাদন নেই। এছাড়া এ বছর আলু উৎপাদনও কম হয়েছে। তাই চাহিদা বেড়েছে। এতে আলুর দাম এবার সামান্য বেড়েছে, আহামরি বাড়েনি।
তিনি বলেন, দাম বাড়ায় সবায় নরে চড়ে বসেছে। গত কয়েক বছর যখন দাম কমছিল, তখন সরকার কেন কোনো ব্যবস্থা নিলো না?
তবে আলুর দাম বাড়ার পেছনে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে কথা স্বীকার করেছেন ব্যবসায়ী শ্যামল সরকার। তিনি বলেন, হিমাগারগুলোতে প্রতিদিন যেমন শতশত বস্তা আলু বিক্রি হচ্ছে, তেমনি আলুর মালিকানার দলিল বিক্রি হচ্ছে।
আরও পড়ুন: ঋণের চাপে যুবকের আত্মহত্যা
এসব দলিল আমাদের মত ব্যবসায়ীরাই একজন আরেক জনের কাছ থেকে কিনছেন। এমনও হয়েছে দুইমাস আগে ৫০ কেজির বস্তার যে দলিল ১৩ শ টাকায় বিক্রি করেছিলাম, সেই দলিল ১৪-১৫ শ টাকায় কিনেছি।
গত ১৫ দিন ধরে একই দলিল ১৬০০-১৭০০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। প্রতিবার হাত বদল হলেই ৫০-১০০ টাকা করে দাম বাড়ছে।
তবে জেলা কৃষি বিপণন কর্মকর্তা এবি এম মিজানুল হক বলেন, আলুর বাজার নিয়ন্ত্রণে ইতিমধ্যে ভোক্তা অধিকারসহ তারা কাজ শুরু করেছেন। বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ীকে জরিমানার আওতায় এনেছেন তারা। আলুর বাজার নিয়ন্ত্রণে তারা অভিযান অব্যাহত রাখবে।
সান নিউজ/এনজে