দক্ষিণাঞ্চলে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির অন্যতম চালিকাশক্তি আটঘর-কুরিয়ানা। বর্ষা এলেই জমে ওঠে ‘বাংলার আপেল’ খ্যাত সুস্বাদু পেয়ারাকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য। ব্যস্ত হয়ে ওঠে পেয়ারা ও সবজিবাগান ঘিরে ট্যুরিস্ট জোনও। দেশ-বিদেশের হাজার হাজার পর্যটক প্রতিদিন ছুটে আসেন দেশের একমাত্র ও সর্ববৃহৎ ভাসমান বাজারটি দেখতে। এখানকার বাসিন্দা, ব্যবসায়ী, ক্রেতা বা পর্যটকের চলাচলে অত্যাবশ্যকীয় ডিঙি নৌকা। ফলে অপার সম্ভাবনার আটঘর-কুরিয়ানায় ফল, সবজি ও পর্যটন শিল্পের পাশাপাশি বিকাশ ঘটছে নৌকা তৈরির কর্মতৎপরতারও। শিল্প বিপ্লবের এই বিংশ শতাব্দীতে গ্রামীণ বাংলার ঐতিহ্যবাহী বাহন তৈরির এলাকাটিও দিনে দিনে তাই পর্যটক, পাইকারি ব্যবসায়ী, ক্রেতা-বিক্রেতার পদচারণায় মুখর থাকার কথা। কিন্তু করোনাকালে কেমন আছেন নৌকার কারিগররা? ডুবি থেকে ফিরে জানাচ্ছেন আমাদের বরিশালের নিজস্ব প্রতিবেদক সৈয়দ মেহেদী হাসান। তিন পর্বের আজ শেষ পর্ব।
ডুবি গ্রামের মুখেই জহুরুলের চায়ের দোকানে ক্যারামে টোকা দিচ্ছিলেন মোতালেব মিয়া। তার কাঁধে ঝুলানো কালো ব্যাগ, ব্যাগের মধ্যে টাকা। তা জানেন চৌকিদার বাড়ির নৌকার মিস্ত্রি হাসান চৌকিদার। মোতালেব মিয়া ক্যারামে লাল ঘুঁটি নিশানা করতে করতে বলছিলেন, ‘হাসনা তোর কতো লাগবে?’ দুই হাতে তালু ঘষে হাসান জবাব দেন, ‘আগের টাকা শ্যাষ। গাছের দাম বাড়ছে। আরও হাজার দশেক দেন।’ মোতালেব মুখ তুলে তাকিয়ে বলেন, ‘ঘরে যা। আইতাছি।’ আনন্দে হাসান হাসতে হাসতে ঘরে ফেরেন।
হাসান মোতালেবকে চেনেন। কিন্তু তার মূল বাড়ি কোথায় বা বিত্তান্ত কিছুই জানেন না। তবে এটা জানেন, বর্ষায় এমন অনেক ফড়িয়া অগ্রিম টাকা নিয়ে আসবেন। আর সেখান থেকে টাকা নিয়ে এ বছরের ব্যবসাটা করবেন। হাসানের চোখে স্বপ্ন একটাই, আগামী নয়মাস ভালো থাকা।
শুধু হাসানই নন, আটঘর-কুরিয়ানা, ভিমরুলি বা তৎসংলগ্ন এলাকায় যতো পানি বাড়ে ততোই আনন্দের জোয়ার ওঠে ডুবি গ্রামের নৌকার কারিগরদের মনে। বর্ষা দীর্ঘস্থায়ী হলে পেনিস ও গলুই নৌকার চাহিদা বেড়ে যায় পেয়ারার ভাসমান বাজারে। নৌকার চাহিদা বেশি মানে মোকামে বেশি দামে নৌকা বিক্রি করা যাবে। অদ্ভুৎ সত্য হলো, পানির দীর্ঘসূত্রতা যতোই দীর্ঘ হোক, ডুবি গ্রামের নৌকার কারিগরদের জীবনের মান উন্নত করতে পারে না কোনো বর্ষা এসেই। যুগ যুগ ধরে অতি দারিদ্র্যের কষাঘাতে নিম্নবিত্তের ঘানি টানছেন নাওপাড়ার বাসিন্দারা।
>>>করোনায় স্থবির ডুবি গ্রাম, দুশ্চিন্তায় নৌকার কারিগর
‘মাত্র বছর দুই হলো ঘরপ্রতি ৪/৫ হাজার টাকা দিয়ে বিদ্যুতের খাম্বা (খুঁটি) বসিয়ে তাতে পল্লীবিদ্যুৎ সংযোগ পেয়েছেন ডুবি গ্রামের বাসিন্দারা। অনেকে হাতুড়ি-বাটুলের বদলে বৈদ্যুতিক মেশিন বসিয়ে নৌকা তৈরি করছেন। তাতে কাজে গতি এসেছে। কিন্তু সংসারে স্বচ্ছলতা ফেরেনি’- বলছিলেন নাওপাড়ার সর্বউত্তরের বাসিন্দা রিপন গোমস্তা।
লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ রিপন পান চিবুতে চিবুতে একরাশ বিরক্তিসহ ছুড়ে ফেলেন পানের পিক। বলেন, ‘বেন বেলা থেইকা চাইরবার কারেন্ট (বিদ্যুৎ) গেছে। বাই, মোগো এহানে কারেন্টে মিস্ড কল দেয়।’
তার আক্ষেপ, দশ গৃহস্থ মিলে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে বিদ্যুৎ এনেছেন ঘরে। কিন্তু লোডশেডিংয়ের কারণে সুফল পাচ্ছেন না। বিপরীতে বিদ্যুৎ ব্যবহার না করলেও বিল দিতে হচ্ছে ঠিকই। রিপন গোমস্তা বলেন, ‘কারেন্টোর লোকতো মিটার দেইখা বিল করে না। তারা আইসে খোঁজ নেন, কার ঘরে কয়টা বাতি, ফ্যান, টিভি আর ফ্রিজ আছে। যার ঘরে দুইটা বাতি, তিনি দিবেন ৩০০ টাকা। যার ঘরে একটা বাতি আর একটা ফ্যান, তিনি দিবেন ৭০০ টাকা। যার ঘরে টিভি, ফ্যান, ফ্রিজ, বাতি সব আছে তার বিল আসে ৩/৪ হাজার টাকা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দুই দফায় বছরের ছয়মাস নৌকার চাহিদা থাকার পরও অনেকে বাকি ছয়মাস কায়ক্লেশে সংসার চালানোর নেপথ্যে দায়ী মধ্যস্বত্বভোগী বা ফড়িয়াদের দৌরাত্ম্য। কারণ, অধিকাংশ নৌকার কারিগর নির্ভরশীল ওই ফড়িয়াদের ওপরে। ফড়িয়া চাইলে নৌকার কারিগরকে ভালো রাখতে পারেন, আবার চাইলে পথের ফকিরে পরিণত করতে পারেন। আর এমন উত্থান বা পতনের জন্যও মাত্র সময় এক বছরের।
এর ব্যখ্যা দিলেন নৌকার মিস্ত্রি হাসান। তিনি বলেন, ডুবি গ্রামের প্রায় তিন হাজার মানুষের মধ্যে ২৩/২৪ শ’ মানুষের প্রধান পেশা নৌকা তৈরি। এতো বড় শ্রমবাজারে ফড়িয়ারা মূলধন খাটান। তারা বর্ষার শুরুতে ঘরে ঘরে গিয়ে টাকা কর্জ দেন। মৌসুমে সেই টাকা নৌকা তৈরি করে তুলতে হয় মিস্ত্রিদের। এর মধ্যে থেকে সুদের টাকাও শোধ করতে হয়।
মূলত ডুবি গ্রামের নৌকার কারিগরদের নিজস্ব বলতে থাকে মিস্ত্রির কাজের সরঞ্জামাদি। আর প্রত্যেক বছরে নৌকা তৈরিতে গাছ কেনা, গাছ স’মিলে নিয়ে কাঠ তৈরি এবং কাঠ এনে বাড়িতে জমানোর পুরো টাকা ফড়িয়াদের কর্জ খরচ করে। আবার নৌকা তৈরি হয়ে গেলে নির্ধারিত ফড়িয়াদের হাত ধরেই নৌকাগুলো যায় ভাসমান ছয়টি মোকামে।
নৌকা মিস্ত্রি আজাহার বলেন, ‘আমরাতো দেড় হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকার মধ্যে নৌকা পাইকারি ব্যবসায়ী/ফড়িয়ার কাছে তুলে দেই। সেই নৌকাই মোকামে বিক্রি হয় তিন থেকে সাত হাজার টাকায়।’
অবশ্য মোকামে গিয়ে নৌকা বিক্রিতে অনাগ্রহের আরেকটি কারণ রয়েছে নাওপাড়ায়। মিস্ত্রি সাইদুল বলেন, নৌকা মোকামে নিতে বেশ ঝক্কি-ঝামেলার ব্যাপার। পুরো একদিন খরচ হয়ে যায় বাজারে আসা যাওয়া করতে। তার ওপরে নৌকা বিক্রি হবে কি না, তা নিয়েও সংশয় থেকে যায়। তার চেয়ে পাইকারি ব্যবসায়ী/ফড়িয়ারা এসে ঘর থেকে নৌকা নিয়ে যান। তাতে সময়ও বাচে। কারণ, যেদিন মোকামে নৌকা নিয়ে যাবেন, ততো সময়ে নতুন দুইটা নৌকা নামাতে পারবেন খালে।
কামরুল চৌকিদার মনে করেন, ‘ফড়িয়াদের ওপর নির্ভরশীলতা না কমাতে পারলে কারিগররা কখনোই ভালো থাকবেন না, আমরা তা বুঝি। কিন্তু ফড়িয়াদের কাছ থেকে যতো সহজে কর্জ পাওয়া যায়, ততো সহজে আবার কোনো ব্যাংক বা এনজিওর কাছে পাওয়া যায় না। আর ব্যাংকেতো কৃষিঋণ রয়েছে, নৌকার কারিগরদের জন্য কোনো ঋণ নেই।’
নেছারাবাদ উপজেলার বলদিয়া ইউনিয়নের ডুবি গ্রামের নাওপাড়ায় বর্ষা আসে বটে খুশির বারতা নিয়ে। তবে সে খুশি স্থায়ী হবে কি না আর নাওপাড়ার মানুষের ভালো-মন্দের জীবন-জীবিকা নির্ভরশীল ফড়িয়াদের মর্জির ওপরে।
স্থানীয়ভাবে জানা গেছে, বর্ষায় দুই ধরনের ফড়িয়ার দেখা মেলে ডুবি গ্রামে। এর মধ্যে বড় অংশ মৌসুমি ফড়িয়া, যারা স্বল্প সুদে টাকা দেন। আর আশপাশের বাজারের যারা পাইকারি ব্যবসায়ী, তারা বেশি সুদে টাকা দেন। মূলত মিস্ত্রিদের সুবিধা ও খাতিরের ওপর নির্ভর করে কর্জ দেন তারা। মিস্ত্রিদের দাবি, নৌকা তৈরিতে সরকার সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা দিলে উন্নয়নের ছোঁয়া জুটতো ডুবি গ্রামে। আটঘর কুরিয়ানার বদৌলতে সমৃদ্ধ জীবন পেতেন নাওপাড়ার অবহেলিত মানুষ।
সান নিউজ/ এআর