দক্ষিণাঞ্চলে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির অন্যতম চালিকাশক্তি আটঘর-কুরিয়ানা। বর্ষা এলেই জমে ওঠে ‘বাংলার আপেল’ খ্যাত সুস্বাদু পেয়ারাকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য। ব্যস্ত হয়ে ওঠে পেয়ারা ও সবজিবাগান ঘিরে ট্যুরিস্ট জোনও। দেশ-বিদেশের হাজার হাজার পর্যটক প্রতিদিন ছুটে আসেন দেশের একমাত্র ও সর্ববৃহৎ ভাসমান বাজারটি দেখতে। এখানকার বাসিন্দা, ব্যবসায়ী, ক্রেতা বা পর্যটকের চলাচলে অত্যাবশ্যকীয় ডিঙি নৌকা। ফলে অপার সম্ভাবনার আটঘর-কুরিয়ানায় ফল, সবজি ও পর্যটন শিল্পের পাশাপাশি বিকাশ ঘটছে নৌকা তৈরির কর্মতৎপরতারও। শিল্প বিপ্লবের এই বিংশ শতাব্দীতে গ্রামীণ বাংলার ঐতিহ্যবাহী বাহন তৈরির এলাকাটিও দিনে দিনে তাই পর্যটক, পাইকারি ব্যবসায়ী, ক্রেতা-বিক্রেতার পদচারণায় মুখর থাকার কথা। কিন্তু করোনাকালে কেমন আছেন নৌকার কারিগররা? ডুবি থেকে ফিরে জানাচ্ছেন আমাদের বরিশালের নিজস্ব প্রতিবেদক সৈয়দ মেহেদী হাসান। তিন পর্বের আজ দ্বিতীয় পর্ব।
নেছারাবাদ উপজেলার বলদিয়া ইউনিয়নের ডুবি গ্রামের জনসংখ্যা প্রায় তিন হাজার। যার তিন চর্তুথাংশের বসবাস নাওপাড়ায়। নৌকা তৈরিই এই গ্রামের মানুষের মূল পেশা। সাধারণত যে ছয়টি মোকামে নৌকা বিক্রি হয়, সেসবের ব্যত্যয় হলে ঘরের বাজারও অনেকের জোটে না। আর সেই কঠিন পরীক্ষার মধ্যে তারা কাটিয়েছেন করোনাকাল।
করোনায় স্বাস্থ্য সচেতনতার সতর্কবার্তা নাওপাড়ায় না পৌঁছালেও অধিকাংশের ঘরে অভাবের কমতি ছিল না। গায়ে গায়ে লাগানো ঝুঁপড়িঘরের বাসিন্দারা তাই করোনায় থেমে ছিলেন না কাজে। সাধ্যমতো তৈরি করেছেন পেনিস ও গলুই নৌকা। কিন্তু পেয়ারা বাগানকেন্দ্রিক আটঘর, বৈঠাকাটা, ইন্দেরহাট, তাড়াইল, আক্তারপাড়া ও পয়সারহাটের ভাসমান মোকামে পাইকারি ব্যবসায়ীরা না আসায় শেষ পর্যন্ত থামিয়ে দিতে হয়েছিল নৌকা তৈরির কাজ। ওই সময়ে শেষ ভরসা ছিল সরকারি সহায়তা।
>>>করোনায় স্থবির ডুবি গ্রাম, দুশ্চিন্তায় নৌকার কারিগর
সরেজমিনে গেলে ডুবি গ্রামের বাসিন্দারা জানান, নাওপাড়ায় দু’ একজন দশ কেজি করে চাল পেয়েছেন। কেউ পেয়েছেন শুধুমাত্র দুই কেজি ডাল। আর বেশিরভাগ মিস্ত্রি পরিবার ছিল সাহায্যের বাইরে। ফলে বাধ্য হয়ে, স্থানীয় এনজিও ও মাতব্বর শ্রেণির মানুষের কাছ থেকে কর্জ করে সংসার চালিয়েছেন। সুদে টাকা নিয়েছেন অধিকাংশ কারিগর। আর করোনার লকডাউন শিথিল হওয়ায় হঠাৎ করেই পাওনাদারেরা চাপ দিচ্ছেন সেই টাকার জন্য। যে কারণে কর্মচাঞ্চল্য ফিরে আসার আগেই ঋণে জর্জরিত মিস্ত্রিরা দিশেহারা।
যদিও ২নং ডুবি ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আব্দুর রহিম সান নিউজকে বলেন, ‘সরকার থেকে যা এসেছে, তাই ভাগ-বাটোয়ারা করে গরিব মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছি।’ তবে তার ওয়ার্ডে দারিদ্র্যের হার যতো বেশি, ততোটা সাহায্য পাননি বলে বন্টনে কষ্ট হয়েছে তারও বলে দাবি করেন।
আব্দুর রহিম বলেন, ‘লকডাউনে ওয়ার্ডের ৫০৬ জনের জন্য দশ কেজি চাল, দুই কেজি ডাল ও তিন কেজি তেল বরাদ্দ আসে। আমি ৫০৬ পরিবারেই খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দিয়েছি। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে ১৯৫ জনকে আড়াই হাজার করে টাকা দেওয়ার তালিকা পাঠিয়েছি। যাদের কেউ কেউ টাকা পেয়েছেন, বাকিরা এখনো পাননি।’ তবে শিগগিরই সেই টাকা পৌঁছাবে বলে আশ্বস্ত করেন আব্দুর রহিম। তিনি আরও বলেন, ওয়ার্ডে গরিবের সংখ্যা বেশি হওয়ায় বরাদ্দ আসা খাদ্য সহায়তা অপ্রতুল ছিল।
তবে নাওপাড়ার বাসিন্দাদের অভিযোগ, মেম্বার তার কর্মীদের মাঝে খাদ্য সহায়তা বিতরণ করেছেন। আর কারও ঘরে চাল, কারও ঘরে তেল, আবার কারও ঘরে ডাল পাঠিয়ে দিয়ে মুখরক্ষা করেছেন মিস্ত্রিদের সাহায্য করেছেন বলে। ন্যূনতম যারা পেয়েছেন, তারাও মাত্র একবার পেয়েছেন। একাধিক কারিগর প্রশ্ন তুলেছেন, চারমাস লকডাউনের মধ্যে মাত্র একবার দশ কেজি চাল পৌঁছালে ওই খাদ্য সামগ্রী দিয়ে একটি পরিবার কতোদিন চলতে পারে?
বিষয়টি ইউপি মেম্বারের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, ‘উপজেলা প্রশাসকে একাধিকবার জানিয়েছি।’
‘চেয়ারম্যান-মেম্বারও বিরুদ্ধে আমার কোনো কতা (অভিযোগ) নাই। হেরা আমগো হগল খাইলেও কমু (বলবো) কিচ্ছু খায় নাই। কারণ, আমরা গরিব। আসল কতা অইলো, করুনায় (করোনা) সময় মোরা না খাইয়া ছেলাম।’ আঞ্চলিক ভাষায় কথাগুলো বলছিলেন পঁচাত্তর বছর বয়সী আজাহার চৌকিদার।
নৌকার কারিগর সাইদুলের অভিযোগ আবার ভিন্ন। তিনি বলেন, ‘নাওয়ের মোকাম বন্ধ হইয়া যাওনের লগে লগেই একটা কিস্তি (ঋণ) তুলছি এনজিও দিয়া। বুঝছি না খাইয়া মরণ লাগবো। কিন্তু চারমাসে যে সুদ ধরছে, হ্যাতে এহন গলায় দড়ি দেওন উচিত।’
সাইদুল বলেন, ‘স্থানীয় যারা সুদে টাকা এনে ঘরের বাজার করেছেন, তারা কাজ শুরু করার আগেই পাওনাদার চাপ দেওয়ায় বিপদে আছেন। প্রত্যেকদিন অন্তত দু’ একটা শালিস হয় ওই পাড়ায়। আবার এনজিওর লোক এসে ঘাপটি মেরে বসে থাকেন দেনাদার ধরতে।’
বাবুল জানিয়েছেন, ফি বছর নৌকা তৈরির মৌসুমে প্রায় প্রত্যেক ঘরে ঋণ তোলা হয়। এ বছরও ঋণ তুলেছেন সবাই। কিন্তু নৌকার যে মূল মৌসুম, তখন করোনায় সবকিছু পণ্ড করে দেওয়ায় ব্যবসায় লোকসান হয়েছে। নৌকা তৈরি করে ঋণের টাকা তুলতেই যেখানে কষ্ট হবে, সেখানে লাভের আশা করাটাও বোকামি। ফলে চলতি বছরের বাকি মাস কেমনে কাটবে তা নিয়ে এখন থেকেই ভাবতে হচ্ছে তাদের।
আরেক মিস্ত্রি কামরুল ইসলাম জানান, সাধারণত ঋণ নিয়ে মৌসুমের শুরুতে গাছ কিনে তা প্রক্রিয়াজাত করে স’মিলে কেটে কাঠ তৈরি করে বড় নৌকায় বাড়িতে এনে জমিয়ে রাখেন মিস্ত্রিরা। সেই তক্তা (কাঠ) দিয়ে পুরো মৌসুমে নৌকা তৈরি করা হয়। এ বছর ঋণ উত্তোলন, গাছ কিনে কাঠ করে পরিবহন ব্যয় দিয়ে প্রত্যেকেই বাড়িতে বাড়িতে কাঠ জমিয়েছেন। কিন্তু যখনই নৌকাগুলো বাজারে বিক্রি শুরু হবে, ঠিক তখনই লকডাউন হওয়ায় আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যায়। যদিও এখন আটঘর-কুরিয়ানা ও ভিমরুলি পর্যটন এলাকায় চলাচল উন্মুক্ত করা হয়েছে; কিন্তু ততোদিনে মৌসুম চলে যাচ্ছে অনেকটা।
নাওপাড়ার মাঝি বেলাল বলেন, ‘পাইকারি ব্যবসায়ীদের নৌকায় নিয়ে মিস্ত্রিদের ঘরে পৌঁছে দিয়ে যে ভাড়া পাই, তাতে আমার সংসার চলে। কিন্তু এ বছর ব্যবসায়ীও আসেননি তেমন। আর মিস্ত্রিরাতো বেকার। ফলে আমিও আয়-রোজগারহীন।
বেলাল জানান, লকডাউনের চারমাসে ২০ হাজার টাকা কর্জ করেছেন তিনি। নৌকার মিস্ত্রিদের সেই অঙ্কটা আবার অনেক বড়। যেমন বৃদ্ধ আজাহার করেছেন এক লাখ আশি হাজার টাকা, বাবুল তিন লাখ টাকা, কামরুল আশি হাজার টাকা, হাসান পঞ্চান্ন হাজার টাকা। এমনকি চা দোকানি হাশেম মিয়ারও পনেরো হাজার টাকা কর্জ করা।
এই পাড়ার বাসিন্দাদের দাবি, দেশের একমাত্র ভাসমান বাজার ও পর্যটনখাতটি টিকিয়ে রেখেছেন ডুবি গ্রামের কারিগররা। তাদের তৈরি সহজলভ্য নৌকার কারণে দিনে দিনে জমজমাট হচ্ছে নদীপ্রধান অঞ্চলটির ব্যবসা-বাণিজ্য। ফলে, সরকার নৌকার মাঝিদের জন্য বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ চালু না করলে জীবিকার তাগিদে এলাকা ছাড়তে হবে তাদের। একদিকে পাওনাদারদের অব্যাহত চাপ, অন্যকে নৌকা তৈরিতে নেওয়া ঋণ শোধের প্রাথমিক পথ রুদ্ধ। বাধ্য হয়েই পেশা পরিবর্তন করতে হবে তাদের।
বলদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাহীন আহম্মেদ সান নিউজকে বলেন, ‘নৌকার মিস্ত্রিদের জন্য আলাদা কোনো সাহায্যের ব্যবস্থা হয়নি। তারা কষ্টে আছেন, এটা সত্য। কিন্তু বরাদ্দ না থাকলে সাহায্য করার কোনো উপায় থাকবে না, এটাও সত্য। তারপরও বলদিয়া ইউনিয়নে যা এসেছে, তা দিয়ে পুরো ইউনিয়নের গরিবদের মাঝে দফায় দফায় বিতরণ করেছি।’ ত্রাণ বিতরণে কোনো অনিয়ম হয়নি বলেও দাবি তার।
সান নিউজ/ এআর