দক্ষিণাঞ্চলে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির অন্যতম চালিকাশক্তি আটঘর-কুরিয়ানা। বর্ষা এলেই জমে ওঠে ‘বাংলার আপেল’ খ্যাত সুস্বাদু পেয়ারাকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য। ব্যস্ত হয়ে ওঠে পেয়ারা ও সবজিবাগান ঘিরে ট্যুরিস্ট জোনও। দেশ-বিদেশের হাজার হাজার পর্যটক প্রতিদিন ছুটে আসেন দেশের একমাত্র ও সর্ববৃহৎ ভাসমান বাজারটি দেখতে। এখানকার বাসিন্দা, ব্যবসায়ী, ক্রেতা বা পর্যটকের চলাচলে অত্যাবশ্যকীয় ডিঙি নৌকা। ফলে অপার সম্ভাবনার আটঘর-কুরিয়ানায় ফল, সবজি ও পর্যটন শিল্পের পাশাপাশি বিকাশ ঘটছে নৌকা তৈরির কর্মতৎপরতারও। শিল্প বিপ্লবের এই বিংশ শতাব্দীতে গ্রামীণ বাংলার ঐতিহ্যবাহী বাহন তৈরির এলাকাটিও দিনে দিনে তাই পর্যটক, পাইকারি ব্যবসায়ী, ক্রেতা-বিক্রেতার পদচারণায় মুখর থাকার কথা। কিন্তু করোনাকালে কেমন আছেন নৌকার কারিগররা? ডুবি থেকে ফিরে জানাচ্ছেন আমাদের বরিশালের নিজস্ব প্রতিবেদক সৈয়দ মেহেদী হাসান। তিন পর্বের আজ প্রথম পর্ব।
বরিশাল: বানারীপাড়া উপজেলার ইলুহার গ্রামের ১৩ বছরের তানভীর বর্ষা এলেই চলে আসে নানাবাড়ি বলদিয়া ইউনিয়নের ডুবি গ্রামে। নিজে আসে বা ছোট মামা সজীব গিয়ে নিয়ে আসেন তার প্রয়োজনে। কারণ, কিশোর বয়সেই নৌকা তৈরির হাতেখঁড়ি হয়ে গেছে তার। বৈঠা, গলুই আর পাটাতন তৈরিতে দক্ষ তানভীর থাকলে অর্ধেকে নেমে আসে সজীবের পরিশ্রম। দিনে একা একটি নৌকা তৈরি করতে পারলেও মাত্র তের বছরের কারিগর তানভীরের সহায়তায় সেই উৎপাদনক্ষমতা দ্বিগুণ হয়ে যায়।
ফলে বর্ষার তিনমাসে অনায়াসে দুই শতাধিক নৌকা তৈরি করতে পারেন মামা-ভাগ্নে। আর তা দিয়ে দুই পরিবার বছরের বাকি নয়মাস কাটিয়ে দিতে পারেন। তবে করোনার কারণে এ বছর ক্রেতা কম।
ডুবি গ্রামের কারিগররা জানিয়েছেন, করোনায় আটঘর-কুরিয়ানার পর্যটন এলাকা ভ্রমণে অনুমতি বন্ধ রেখেছে স্থানীয় প্রশাসন। ফলে এ বছর পর্যটক আসছেন খুবই কম। মূলত, পর্যটকদের ভ্রমণে অনুমতি দিলে পেনিস ও গলুই নৌকায় করে পেয়ারা বাগান ও ভাসমান বাজার দেখতে বের হন অনেকেই। তখন পর্যটকদের কথা মাথায় রেখে নৌকার চাহিদা বেড়ে যায়। কিন্তু এ বছর আর সেই চাহিদা নেই। সে কারণে নৌকার কারিগরদের ঘরে আগের বছরের মতো কর্মচাঞ্চল্য নেই।
ইলুহার গ্রামের সাইদুলের বড় ছেলে তানভীর জানায়, চার সদস্যের সংসারে সে ও তার বাবা রোজগারক্ষম। বাবা অন্যের জমিতে ‘কামলা’ দেন। আর সে নানা বাড়ি এসে নৌকা তৈরিতে সহায়তা করছে গত তিন বছর ধরে। লেখাপড়া এখনো করছে। ইলুহারের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা (পিইসি) দেবে।
‘কিন্তু স্কুলের নাম মনে নেই’- নৌকার পাটাতনের তক্তা (কাঠ) কাটতে কাটতে বলছিল তানভীর।
ডুবি গ্রামের মুখে জহুরুলের চায়ের দোকান পার হলেই চৌকিদার বাড়ি। অনেক আগে এই বাড়ির গোরাপত্তন যিনি করেছেন, তিনি চৌকিদার ছিলেন। তার নামেই বাড়ির নামকরণ। মজার কথা হলো, পুরনো সেই আমলে কার দাদা বা তালুই চৌকিদার ছিলেন, সেই তথ্য জানা নেই কারও। চৌকিদার বাড়িতে কম করে হলেও ২৫ বাসিন্দার নিবাস। ২৫ ঘরেই চলছে নৌকা তৈরির কাজ।
প্রথম ঘরটি হাসানের। তিনি এইসএসসি পাস মিস্ত্রি। বন্ধুরা কেউ কেউ বিএ পাস করেছেন, কিন্তু চাকরি জোটেনি। দু’একজন এনজিওতে আছেন। আবার অনেকে কোম্পানির সেলসম্যান হিসেবে কাজ করছেন। সঙ্গত কারণেই লেখাপড়া থেকে মন উঠে গেছে হাসানের। তার ছোট ভাই মেহেদীও কাজ করছেন মন দিয়ে।
হাসান বলেন, ‘আব্বার হাতে কাজ শিখছি। নৌকা তৈরি করে ভালোই ছিলাম। তবে করোনায় ক্রেতা না থাকায় সংকটে পড়ে গেছি।’
হাসানের ইচ্ছা, আগামী মৌসুমে বড় কারখানার মতো করবেন। যাতে কয়েকজন মিস্ত্রিও রাখবেন।
চৌকিদার বাড়ি পার হতেই দেখা মেলে পঁচাত্তর বছর বয়সী আজাহারের। তার ছেলে শাহীন বাড়িতে থাকেন না। ডুবিতে যে নৌকা তৈরি হয়, তার চেয়ে অনেক ভালো নৌকা তৈরি করতে পারেন একমাত্র ছেলেটি। তিনি এখন ঢাকার সাভারে এক কোম্পানিতে কোষা নৌকা তৈরি করেন। বিপরীতে আজাহার জীবন সায়াহ্নেও হাতুড়ি চালান কুরিয়ানার পেয়ারা বাগানে ভাসাতে তৈরি হওয়া ছোট ছোট নৌকায়।
আজাহার বলেন, কতো সালে নৌকা তৈরিতে হাত দিয়েছেন জানেন না। তিনিও তার বাবার কাছ থেকে শিখেছেন। তখন অর্থনৈতিক অবস্থা তাদের মোটেই ভালো ছিল না। নিজেরা নৌকা তৈরি করবেন, কাঠ কেনার সেই টাকাও ছিল না বাবা রহিমুদ্দির। শেষে আজাহারকে হাতে ধরে বাপ-ছেলে গোমস্তা বাড়িতে যেতেন নৌকা বানানোর সহযোগী হিসেবে।
বাবার মৃত্যুর পর পাঁচ পয়সায় নৌকার কারিগর হিসেবে দিনমজুরি করতেন আজাহার। এখন মিস্ত্রি রাখলে মাসে ১৫ হাজার টাকা দিতে হয়। অর্থাৎ ৫০০ টাকা প্রতিদিন।
আজাহার বলেন, ‘পাঁচ পয়সা থেকে দেখতে দেখতে ৫০০ টাকার জমানা দেখছি। দুনিয়াটা অনেক রহস্যের। কারও কাছে ডিঙি, আবার কারও কাছে বজরা, নয়তো কোষা নৌকার মতো।’
দিনে পাঁচ টাকার মজুরিতে কাজ শুরু করেছিলেন বাবুল। চল্লিশ বছরের বাবুল এখন সবচেয়ে ধণাঢ্য নৌকার কারিগর ডুবি গ্রামে।
তিনি জানান, কষ্ট ও ঝুঁকি নিয়ে নৌকা তৈরির কারখানাই করে ফেলেছেন। প্রতিদিন তার কারখানা থেকে চারটি নৌকা নামানো সম্ভব। কারিগর রেখেছেন চারজন। সহযোগী আরও চারজন। মাসে যাদের লাখ টাকা মাইনে দিতে হয়।
আগামীকাল পড়ুন: ঋণের বোঝায় ন্যূজ্ব নাওপাড়ার মানুষ, জোটেনি সাহায্য
সাধারণত পেয়ারা বাগানকেন্দ্রিক ছয়টি ভাসমান মোকামে নৌকা বিক্রি হয়। মোকামগুলো হলো, আটঘর, বৈঠাকাটা, ইন্দেরহাট, তাড়াইল, আক্তারপাড়া ও পয়সারহাট। পাইকারি ব্যবসায়ীরা ডুবি গ্রামে এসে বাড়িতে বাড়িতে অর্ডার দিয়ে যান। আবার অনেকে নৌকা তৈরি করে রাখেন, বাড়িতে এসে ট্রাকে করে নিয়ে যান ব্যবসায়ীরা।
কুরিয়ানার নৌকার কারিগর কামরুল চৌকিদার বলেন, নৌকা তৈরির মূল মৌসুম বর্ষার তিনমাস। এই সময়ে ব্যাপক চাহিদা থাকে। আরও তিনমাস অল্প-বিস্তর চাহিদা থাকে। তারপর বাকি ছয়মাস কোনো চাহিদাই থাকে না।
বলদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের ডুবি ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আব্দুর রহিম জানিয়েছেন, তার ওয়ার্ডে দুই হাজার ৪০০ জন ভোটার। শিশু মিলিয়ে এই ওয়ার্ডে তিন হাজারের মতো নিবাসী। যার মধ্যে প্রায় ৭০০ মানুষ অন্য পেশায় নিযুক্ত। বাকিরা নৌকা তৈরি করে জীবন চালান।
ডুবি গ্রামের গোমস্তা বাড়ির পুরনো কারিগর রিপন গোমস্তা বলেন, ‘পেয়ারা বাগান ও আটঘর-কুরিয়ানা, ভিমরুলির জন্য আমরা দুই ধরনের নৌকা তৈরি করে থাকি। পেনিস ও গলুই নৌকা। এর মধ্যে পেনিস নৌকা সাধারণত পেয়ারা সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা নিয়ে থাকেন। এর দামও কম। আড়াই হাজার টাকা থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত। গলুই নৌকা হচ্ছে বীজ বা চারা বহনের জন্য। গলুই নৌকার দাম দেড় হাজার টাকা থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকার মধ্যে। এ নৌকাগুলো এক বছরের বেশি যায় না।’
স্বরূপকাঠি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোশারফ হোসেন বলেন, পর্যটনের জন্য আটঘর-কুরিয়ানাসহ ভাসমান বাজারের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। অল্প কয়েকদিন হলো পর্যটক আসতে শুরু করেছেন। তবে পর্যটকদের অবশ্যই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।
তিনি বলেন, সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে খুলে দেওয়া হয়েছে পর্যটনের এলাকাগুলো।
সান নিউজ/ এআর