নৌশিন আহম্মেদ মনিরা: বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, মহামারি করোনাভাইরাসের নেতিবাচক প্রভাব থেকে বের হয়ে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল করতে কুটির, মাইক্রো ও ক্ষুদ্র শিল্প খাতের (সিএমএসএমই) উদ্যোক্তাদের সক্ষমতা ধরে রাখতে জামানত (মর্টগেজ বা সিকিউরিটি) ছাড়া ঋণ সুবিধা দিতে প্রস্তুত ব্যাংকগুলো। আর সেই ঋণের গ্যারান্টার হবে স্বয়ং বাংলাদেশ ব্যাংক।
এ ক্ষেত্রে যেসব ছোট উদ্যোক্তার জামানত দেওয়ার সক্ষমতা নেই, তাদের কথা মাথায় রেখেই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ জন্য গত বছরের ২৭ জুলাই ২ হাজার কোটি টাকার স্কিমও গঠন করা হয়। যে তহবিলের আওতায় আট হাজার ৩২০ কোটি টাকার ঋণের গ্যারান্টি দেওয়া হবে।
এদিকে মঙ্গলবার (২১ সেপ্টেম্বর) ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিমের সুবিধা দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি করা ৩১ প্রতিষ্ঠান, দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নাম ও ফোন নম্বর প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম (সিজিএস) ইউনিটের তথ্য মতে প্রচারের অভাবে এই স্কিমের কথা জানেন না বেশিরভাগ ছোট উদ্যোক্তা।
এদিকে ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা পর্যন্ত পৌঁছাতে ব্যাংকগুলোর যে নেটওয়ার্ক থাকার কথা সেটা নেই। যে কারণে এই ঋণ জনপ্রিয় হয়নি।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতের (সিএমএসএমই) জন্য গেলো বছরের এপ্রিলে ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছিল। জামানত না থাকায় ওই সময় উদ্যোক্তাদের অধিকাংশই ঋণ পাননি। সম্ভাবনাময় ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা যেন এই প্যাকেজ থেকে ঋণবঞ্চিত না হন সেই লক্ষ্যে ব্যাংকগুলোকে ঋণের গ্যারান্টি দিতে ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম চালু করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
২১ সেপ্টেম্বর জারি করা নির্দেশনায় উল্লেখ করা হয়েছে, ‘আপনি কি একজন কুটির, মাইক্রো ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা? করোনা মহামারির প্রাদুর্ভাবে কি আপনার ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান বা উদ্যোগ ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে? মর্টগেজ বা সিকিউরিটির অভাবে ঋণ বা বিনিয়োগ পাচ্ছেন না? আপনি কি একজন সিএমএস নারী উদ্যোক্তা? আপনার প্রতিষ্ঠানের জন্য জামানতবিহীন ঋণ বা বিনিয়োগ পেতে কি গ্যারান্টির প্রয়োজন? তাহলে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে কুটির, মাইক্রো ও ক্ষুদ্র শিল্পের (সিএমএস) জামানতবিহীন ঋণ বা বিনিয়োগ প্রাপ্তির জন্য ক্রেডিট গ্যারান্টি সুবিধা পেতে আজই আপনার নিকটস্থ পিএফআইভুক্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।’
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী জামানতবিহীন ছোট ঋণের জন্য ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিমের অন্তত ১০ শতাংশ নারী উদ্যোক্তাদের জন্য সংরক্ষণ করতে হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, ২০২৪ সালের মধ্যে অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারীর সম্পৃক্ততা বাড়াতে ব্যাংকগুলোর সিএমএসএমই খাতের মোট ঋণের অন্তত ১৫ শতাংশ তাদের মাঝে বিতরণের নির্দেশনা রয়েছে। এখন এটা ৪ শতাংশ।
জানা যায়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ ধরনের গ্যারান্টি স্কিম চালু থাকলেও বাংলাদেশে এটি নতুন। করোনার কারণে প্রচার না থাকায় ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা এর বিষয়ে জানতেন না।
নিয়ম মেনে কোনও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা এই সুবিধা নিতে চাইলে ব্যাংকের কাছে আবেদন করবেন। ব্যাংক সেই আবেদন যাচাই-বাছাই করে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক সিজিএস ইউনিটের কাছে পাঠাবে।
এছাড়া গত ২৭ জুলাই এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা স্কিমটিতে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য বলা হয়েছিলো,
১. নতুন ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম এর জন্য সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক প্রয়োজনীয় তহবিলের সংস্থান করবে। তহবিলের পর্যাপ্ততার উপর ভিত্তি করে স্কিমে অংশগ্রহণকারী প্রত্যেক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য কুটির, মাইক্রো ও ক্ষুদ্র (এসএম্ই) খাতে চলতি মূলধন ঋণ বা বিনিয়োগের জন্য নির্ধারিত পোর্টফোলিও সীমার সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ পর্যন্ত পোর্টফোলিও গ্যারান্টি ক্যাপ দেওয়া হবে। উক্ত পোর্টফোলিও গ্যারান্টি ক্যাপের আওতায় কোনো একক উদ্যোক্তা ঋণ বা বিনিয়োগ গ্রহীতার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৮০ শতাংশ পর্যন্ত গ্যারান্টি কাভারেজ দেওয়া হবে।
২. পোর্টফোলিও সীমার আওতায় গ্যারান্টি সুবিধা পাবে কুটির, মাইক্রো ও ক্ষুদ্র উদ্যোগের আওতায় ম্যানুফ্যাকচারিং ও সেবা খাতে সর্বোচ্চ ৭০ শতাংশ এবং কুটির, মাইক্রো ও ক্ষুদ্র উদ্যোগের আওতায় ব্যবসা খাতে সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ।
৩. ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিমের আওতায় গ্যারান্টি সুবিধার জন্য আবেদন করা হবে তার আগের বছরের ৩১ ডিসেম্বর ভিত্তিক শ্রেণীকৃত ঋণ ১০ শতাংশ বা তার কম– এ ধরনের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান নতুন এই স্কিমের জন্য যোগ্য বিবেচিত হবে। তবে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংকের ঋণ বা নিয়োগ সুবিধার ক্ষেত্রে গ্যারান্টি সুবিধার জন্য এ বিধি–নিষেধ প্রযোজ্য হবে না।
৪. ঋণ বা বিনিয়োগের জন্য সীমা যাই থাকুক না কেন ক্রেডিট স্কিমের আওতায় গ্যারান্টির জন্য ঋণ বা বিনিয়োগ সুবিধার পরিমাণ হবে সর্বনিম্ন ২ লাখ টাকা এবং সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকা।
৫. নতুন স্কিমের আওতায় প্রদেয় গ্যারান্টির মেয়াদ হবে প্রাথমিকভাবে এক বছর। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ঋণ বা বিনিয়োগ সম্পূর্ণ আদায় হয়ে থাকলে সংশ্লিষ্ট ঋণ বা বিনিয়োগের গ্যারান্টির মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। তবে কোনো ঋণ বা বিনিয়োগের সুবিধা নবায়ন বা পুনঃতফসিল করা হলে নবায়নের সময়কে গ্যারান্টির মেয়াদ হিসেবে ধরা হবে। এক্ষেত্রে ঋণ–বিনিয়োগের মেয়াদ বৃদ্ধি এবং নবায়ন বা পুনঃতফসিলের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে সিজিএস ইউনিট থেকে গ্যারান্টির মেয়াদ বাড়িয়ে নিতে হবে। গ্যারান্টি রেজিস্ট্রেশনের আবেদনের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান তাদের অনুমোদিত ঋণ নীতিমালার আওতায় গ্রাহকের ঋণ বা বিনিয়োগ আবেদন যথাযথভাবে যাচাই–বাছাই করা হয়েছে মর্মে প্রত্যায়নপত্র দিতে হবে।
৬. প্রতি মাসের প্রথম ১০ কার্যদিবসের মধ্যে গ্যারান্টি রেজিস্ট্রেশনের জন্য আবেদন করতে হবে। গ্যারান্টি রেজিস্ট্রেশনের সময় পোর্টফোলিও সীমা যাতে অতিক্রম না করে তা সিজিএস ইউনিট নিশ্চিত করবে। সিজিএস ইউনিট হতে রেজিস্ট্রেশন প্রাপ্তির পর সংশ্লিষ্ট ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান যথাযথ ডকুমেন্টেশন শেষ করে উদ্যোক্তার অনুকূলে ঋণ বা বিনিয়োগ সুবিধা মঞ্জুরীপূর্বক বিতরণ করবে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘গ্রাহক নিজে নির্বাচন করে ব্যাংক। আবার ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে সম্ভাবনাময় উদ্যোক্তাকেই বাছাই করে ব্যাংক। এ কারণে অনেক সময় কাঙ্ক্ষিত উদ্যোক্তা পাওয়া যায় না।’
সান নিউজ/এনএএম