নিজস্ব প্রতিবেদক: সরকার এত নিয়ম-কানুন করার পরও ব্যাংকগুলোর কোন হুঁশ ফিরছে না। যাচাই-বাছাই না করেই ঋণ দিয়ে বিপাকে পড়েছে সরকারি-বেসরকারি ৮টি ব্যাংক। তাদের মোট বিতরণকৃত ঋণের ৮০ থেকে ৯৭ শতাংশই আদায় অযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। এসব ঋণের বিপরীতে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে কয়েকটি ব্যাংক। মূলধন ঘাটতিতেও রয়েছে কেউ কেউ।
জালিয়াতি, অর্থ আত্মসাৎ আর বিভিন্ন অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার কারণে বিতরণের এসব ঋণ আদায় হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে গেছে। এছাড়া নানা অজুহাতে দেয়া হচ্ছে সুযোগ-সুবিধা। সুদ মওকুফ, পুনঃতফসিল, পুনর্গঠন, অবলোপনসহ বেশকিছু প্রণোদনা প্যাকেজ দেয়া হচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকে। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, প্রভাবশালীদের চাপে অনিচ্ছা সত্ত্বেও এসব সুবিধা দিয়ে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতো সুযোগ দেয়ার পরও মন্দ ঋণের বড় ঝুঁকি হতে উঠতে পারছে না সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলো।
সাধারণত ‘নন-পারফর্মিং’ ঋণের শ্রেণিকরণ তিন ধরনের হয়। ‘সাব-স্ট্যান্ডার্ড’ (তিন মাসের বেশি অনাদায়ী), ‘ডাউটফুল’ (নয় মাসের বেশি অনাদায়ী) এবং ‘ব্যাড ডেট বা লস’ (এক বছরের বেশি সময়ের জন্য অনাদায়ী)।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে জানা যায়, চলতি বছরের মার্চ শেষে এক বছরের বেশি সময় অনাদায়ী এমন ‘ব্যাড/লস’ বা মন্দ ঋণের পরিমাণ ৮৩ হাজার ৬৭১ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৭ দশমিক ১০ শতাংশ। কোনো ব্যাংকের মন্দ ঋণের এ হার ৯০ শতাংশের বেশি।
মন্দ ঋণে শীর্ষ অবস্থানে ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান (এনবিপি)। ব্যাংকটির এক হাজার ৩৯১ কোটি টাকার বিতরণ করা ঋণের মধ্যে ৯৭ দশমিক ৬৯ শতাংশই আদায় অযোগ্য। এরপর পরের অবস্থানে আছে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক। তাদেও বিতরণ করা ৮৫৬ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে ৬৫৮ কোটি অর্থাৎ ৭৬ দশমিক ৮৭ শতাংশই ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ।
মন্দ ঋণের বড় ঝুঁকিতে রয়েছে পদ্মা ব্যাংক (সাবেক ফারমার্স ব্যাংক)। নামে পদ্মা হলেই কি সে পদ্মানদীর মতো ঝড় তুলতে পারেনি শুরু থেকেই। নাম বদলালেও গতি বদলাতে পারেনি। ব্যাংকটির বিতরণ করা পাঁচ হাজার ৬৫৩ কোটি টাকার ঋণের মধ্যে তিন হাজার ৫৭৭ কোটি টাকা অর্থাৎ ৬৩ দশমিক ২৭ শতাংশই খেলাপি ঋণ।
বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের দুই হাজার ২৬৭ কোটি টাকার ঋণের মধ্যে ৪৬ দশমিক ৫৪ শতাংশ অর্থাৎ এক হাজার ৫৫ কোটি টাকা ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ।
ঋণঝুঁকির শীর্ষে থাকা অন্যতম রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংক। মার্চ পর্যন্ত ব্যাংকটি ১৪ হাজার ৬০১ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে। এর মধ্যে সাত হাজার ৮৮৩ কোটি টাকা অর্থাৎ প্রায় ৫৪ শতাংশ ঋণই আদায় অযোগ্য মন্দ ঋণে পরিণত হয়েছে।
সরকারি মালিকানাধীন বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড (বিডিবিএল) মার্চ পর্যন্ত ঋণ বিতরণ করেছে এক হাজার ৮৩৫ কোটি টাকা, যার ৩৩ দশমিক ২৬ শতাংশই মন্দ ঋণ।
বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের দুই হাজার ২০৫ কোটি টাকা ঋণের ৪৪ দশমিক ৯২ শতাংশ অর্থাৎ ৯৯০ কোটি টাকা ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ।
মন্দ ঋণের বড় ঝুঁকিতে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ও জনতা ব্যাংক। মার্চ পর্যন্ত জনতা ব্যাংক ঋণ বিতরণ করেছে ৫৭ হাজার ৮৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে মন্দ (ব্যাড ডেট বা লস) ঋণের পরিমাণ ১৩ হাজার ২০৮ কোটি টাকা অর্থাৎ ২৩ দশমিক ১৪ শতাংশ।
সোনালী ব্যাংক মার্চ পর্যন্ত ঋণ বিতরণ করেছে ৫৩ হাজার ৯৬৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রায় ২০ শতাংশ অর্থাৎ ১০ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকা আদায় অযোগ্য মন্দ ঋণ।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, দীর্ঘদিন ধরে বেশকিছু ব্যাংক দুর্বল অবস্থায় পড়ে আছে। তাদের উন্নয়নে বিশেষ পদক্ষেপ প্রয়োজন। যাদের অবস্থা বেশি খারাপ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত তাদের ঋণ আদায়ে টার্গেট বেঁধে দেয়া।
সাননিউজ/এফএআর