চট্টগ্রাম ব্যুরো: দক্ষিণ এশিয়ায় মিঠা পানির একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদীতে ডিম ছেড়েছে মা মাছ। কিন্তু তিনদিনেও প্রত্যাশিত ডিম না পেয়ে হতাশ ডিম সংগ্রহকারীরা।
সংগ্রহকারীরা জানান, মঙ্গলবার (২৫ মে) রাত ১১ টার দিকে নমুনা ডিম দেয় মা মাছ। এসময় হালদা পাড়ের ডিম সংগ্রহকারীরা ১০০ থেকে ২০০ গ্রাম পর্যন্ত নমুনা ডিম সংগ্রহ করে। বুধবার সকালেও অল্প পরিমাণ নমুনা ডিম দেখা যায়। কিন্তু বৃহস্পতিবার বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করেও আর ডিম পাওয়া যায়নি।
তবুও ডিম পাওয়ার আশায় শুক্রবারও (২৮ মে) নদীতে রয়েছেন তারা। এই সময়ে ৬ হাজার ৫০০ কেজির মতো ডিম সংগ্রহ হয়েছে বলে জানান চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফারহানা লাভলী। তিনি বলেন, ঘুর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে সাগরের প্রবল জোয়ারে হালদা নদীতেও লবণাক্ত পানি প্রবেশ করেছে। এছাড়া বজ্রবৃষ্টির অভাবে হালদা নদীতে ঢলের সৃষ্টি না হওয়ায় মা মাছ এখনো পর্যাপ্ত ডিম ছাড়েনি।
তিনি বলেন, নদীতে ঢলের সৃষ্টি হলে মা মাছ ডিম ছাড়ে। আমরা এখনো আশাবাদি সামনের জো-তে বজ্রবৃষ্টি হলে নদীর ঢলে মা মাছ ডিম ছাড়বে। এবার ২৫ থেকে ৩০ হাজার কেজি ডিম সংগ্রহের আশা রয়েছে। গত বছর ২৫ হাজার ৫৩৬ কেজি ডিম সংগ্রহ করেছিলেন ডিম সংগ্রহকারীরা।
তিনি আরও বলেন, এবার ২৪৩টি নৌকা ও প্রায় ৭০০ডিম সংগ্রহকারী হাটহাজারীর এলাকার রামদাস মুন্সিরহাট, অঙ্কুরি ঘোনা, আজিমের ঘাটসহ কয়েকটি পয়েন্টে ডিম আহরণ করছে। তবে আশানুরুপ ডিম সংগ্রহ করতে পারছে না বলে জানিয়েছেন সংগ্রহকারী।
তারা বলছেন, যে পরিমাণ ডিম সংগ্রহ করবো ভেবেছি তা এখনও পর্যন্ত হয়নি। অল্প ডিম মাত্র পেয়েছি। আমরা এখনও আশায় আছি। নদীর পানিতে লবণাক্তের পরিমাণ কেটে গেলে মা মাছ হয়তো আবার ডিম ছাড়বে।
ডিম সংগ্রহকারী কামাল উদ্দিন বলেন, আমরা এখনও নৌকা নিয়ে নদীর মাঝে আছি। প্রায় ৪ বালতি ডিম সংগ্রহ করেছি। এখনও কাঙ্ক্ষিত ডিম সংগ্রহ করতে পারিনি।
ডিম সংগ্রহকারী রোশাঙ্গীর আলম বলেন, আমরা যা আশা করেছি সেভাবে ডিম পাচ্ছি না। অল্প ডিম পেয়েছি মাত্র। ডিম সংগ্রহ করার জন্যে অনেক টাকা খরচ করতে হয়। নৌকা, জাল, কুপ সংস্কার এসবের জন্যে ৫০/৬০ হাজার টাকা খরচ হয়। অনেকের আরও বেশি হয়। তবে আমরা এখনও আশাবাদী।
মা মাছ ডিম ছাড়ে যখন
বছরের এপ্রিল থেকে জুনের যেকোনো সময়ে হালদা নদীতে মা মাছ ডিম ছাড়ে। তবে পূর্ণিমা বা অমাবস্যার তিথিই ডিম ছাড়ার নিয়ম। একই সময়ে নদীর স্থানীয় এবং খাগড়াছড়ি, মানিকছড়িসহ নদীর উজানে পাহাড়ি এলাকায় প্রচুর বজ্রসহ বৃষ্টিপাতও হতে হবে। এতে নদীতে ফেনাসহ পাহাড়ি ঢল নামে। ঠিক এই সময়ে পূর্ণ জোয়ার শেষে বা পূর্ণ ভাটা শেষে পানি যখন স্থির হয় তখনই কেবল মা মাছ ডিম ছাড়ে।
হালদা গবেষকরা বলছেন, এ বছরের এপ্রিল মাস শুরু হওয়ার পরে ইতোমধ্যে তিনটি জো চলে গেছে। কিন্তু পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হওয়ায় নদীতে উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি। তাই মা মাছ ডিম ছাড়েনি। সর্বশেষ ২৪ মে থেকে পূর্ণিমার জো শুরু হয়েছে। ২৯ মে পর্যন্ত এটা স্থায়ী হবে। এরমধ্যেও যদি মা মাছ ডিম না ছাড়ে, তাহলে সামনে অমবস্যার জো পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির কো-অর্ডিনেটর অধ্যাপক ড. মঞ্জুরুল কিবরিয়া বলেন, পূর্ণিমা তিথিতে বৃষ্টি হয়নি। অপরদিকে জোয়ারের পানি ঢুকে মিঠা পানির হালদা নদীর চিরায়ত বৈশিষ্ট্য নষ্ট করে দিয়েছে। যেখানে লবণাক্ততা থাকার কথা ১ পিপিটি, সেখানে আমরা পেয়েছি ৩৬ থেকে ৪০ পিপিটি। যার কারণে দুবার নমুনা ডিম ছেড়েও পর্যাপ্ত ডিম ছাড়তে পারেনি মা মাছ।
শুধু তাই নয়, এই লবণাক্ততায় হালদার দুই পাড়ের ফসলেরও প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ক্ষেত-খামার দেখে মনে হচ্ছে কেউ অ্যাসিড দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে। হালদার পানিতে লবণাক্ততা বাড়ায় ওয়াসার পানি উৎপাদনও বিঘ্নিত হয়েছে।
চট্টগ্রাম ওয়াসার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সাদেক উদ্দিন চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বলেন, স্বাভাবিক অবস্থায় হালদার পানিতে লবণাক্ততা থাকে ২৫ মিলিগ্রাম পার লিটার। সেই জায়গায় বুধবার ছিল ৩ হাজার ৬০০ মিলিগ্রাম পার লিটার, বৃহ¯পতিবার ছিল ৪ হাজার মিলিগ্রাম পার লিটার।
সান নিউজ/আইকে/আরআই