রাসেল মাহমুদ : আলোচিত পি কে হালদারের তিন প্রতিষ্ঠানে ৫০ কোটিসহ প্রায় ৫০০ কোটি টাকা খেলাপী ঋণ নিয়ে ডুবতে থাকা পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতের কোম্পানি ফারইস্ট ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড দখলের অভিযোগ উঠেছে। নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) গঠন করে দেয়া বোর্ড উপেক্ষা করে সাবেক চেয়ারম্যান সামসুল ইসলাম ভরসা প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কার্যালয় থেকে গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র নিয়ে গেছেন। এ কাজে তিনি নিজস্ব একটি বাহিনী ব্যবহার করেছেন বলেও জানা গেছে।
প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মরত একাধিক কর্মকর্তা বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তারা বলছেন, বিএসইসি বোর্ড গঠন করে দেয়ার পরও তা মেনে না নেয়া সরকারকে উপেক্ষা করার শামিল। সরকারকে বিব্রত করতে এবং দুর্নীতি আড়াল করতেই অফিস থেকে কাগজপত্র সড়ানো হয়েছে।
জানা গেছে, চরম তারল্য সংকট, আমানত ফেরত প্রদানে অক্ষম, শত শত কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে নিজে ঋণ খেলাপী হয়ে পড়া, বড় অঙ্কের পুঞ্জিভূত লোকসান, খেলাপী ঋণসহ নানা সমস্যা জর্জরিত কোম্পানিটি। এছাড়াও কোম্পানিটির মূলধন বর্তমানে শুন্যের কোটায়।
এছাড়া পরিচালকদের অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে না পারার অভিযোগ বেশ পুরোনো। এমনকি ২০১৭ সাল থেকে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদেরও কোনো লভ্যাংশ দিতে পারছে না কোম্পানিটি। প্রতিষ্ঠানটির অনিয়মের সঙ্গে সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তারাও জড়িত বলে বিভিন্ন সময় আলোচনায় এসেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৯ মার্চ প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করে বিএসইসি।
পুনর্গঠিত বোর্ডে নতুন করে ছয়জন স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দেয়া হয়। পাশাপাশি ফারইস্টের আর্থিক হিসাবসহ অন্যান্য বিষয় যাচাইয়ের জন্য বিশেষ নিরীক্ষারও সিদ্ধান্ত নেয় কমিশন।
নিয়োগ পাওয়া স্বতন্ত্র পরিচালকেরা হলেন- সরকারের সাবেক সচিব ও সোনালী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান মো. আশরাফুল মকবুল, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের সাবেক অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক এহসানুল আজিজ, সাংবাদিক শেখ নাজমুল হক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক সজীব হোসাইন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট কনসালট্যান্সির পরিচালক মোশাররফ হোসাইন ও সিনিয়র কনসালট্যান্ট একেএম শহিদুজ্জামান। তাদের মধ্যে চেয়ারম্যান করা হয় মো. আশরাফুল মকবুলকে।
নতুন স্বতন্ত্র পরিচালকদের সঙ্গে পর্ষদে পরিচালক পদে রাখা হয়েছে তিনজন শেয়ারধারী পরিচালক। তারা হলেন সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান সামসুল ইসলাম ভরসা, খাদিজা ওয়াহিদা জাহান ও রিমসা বিডির মনোনীত পরিচালক আসাদুজ্জামান। কমিশনের অনুমোদন ছাড়া প্রতিষ্ঠানটি সম্পদ বিক্রি, বন্ধকি, হস্তান্তর বা নিষ্পত্তি করতে পারবে না বলে জানিয়েছে বিএসইসি।
কোম্পানি সূত্রে জানা গেছে, ২৯ মার্চ বোর্ড পুনর্গঠন করার পর ১ এপ্রিল আগারগাঁওয়ে বিএসইসি কার্যালয়ে একটি মিটিং হয়। এরপর গত ১৪ এপ্রিল থেকে সর্বাত্মক লকডাউন শুরু হলে অন্যান্য সব অফিসের মতো ফারইস্ট ফাইন্যান্সও বন্ধ থাকে। কিন্তু লকডাউনের ছুটি উপেক্ষা করে ১৫ এপ্রিল প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয় দখল করেন সাবেক চেয়ারম্যান ও বর্তমান পরিচালক সামসুল ইসলাম ভরসা। এ সময় তিনি গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র নিয়ে যান বলে জানা গেছে।
বিষয়টি স্বীকার করেছেন ফারইষ্ট ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী জারিয়াব। সাননিউজকে তিনি বলেন, ১৫ এপ্রিল অতর্কিতভাবে সাবেক চেয়ারম্যান অফিস দখল করেন। এ সময় তিনি গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র নিয়ে যান।
তিনি বলেন, বিএসইসি বোর্ড পুনর্গঠন করেছে। সেখানে সামসুল ইসলাম ভরসাকেও পরিচালক হিসেবে রাখা হয়েছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হয়েও তিনি এমন করেছেন; যা সরকারি সিদ্ধান্ত অমান্যের শামিল।
কেন তিনি অফিস দখল করতে চান এমন প্রশ্নের জবাবে মোহাম্মদ আলী জারিয়াব বলেন, এর দুটো কারণ হতে পারে। এক সরকারকে বিব্রত করা। দুই তার দুর্নীতির প্রমাণ গায়েব করা। তাছাড়া আমার কাছে সামগ্রিকভাবে মনে হয়, দেশের আর্থিক খাতকে তিনি প্রশ্নবিদ্ধ করতে চেয়েছেন। তা-না হলে বোর্ডে থেকেও কেনো তিনি এটা করবেন।
বিষয়টি বিএসইসিকে জানানো হয়েছে কিনা তা জানতে চাইলে এই কর্মকর্তা বলেন, আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়নি। তবে আমাদের নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিএসইসি চাইলে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।
চেয়ারম্যান হিসেবে সামসুল ইসলাম ভরসাকে কোম্পানি যেসব গ্যাজেট (গাড়িসহ আনুষঙ্গিক জিনিস) দিয়েছিলো তিনি এখনো তা হস্তান্তর না করে নিজেই ব্যবহার করছেন বলে জানান মোহাম্মদ আলী।
তবে অভিযোগের বিষয়ে জানতে একাধিকবার ফোন করলেও ফোন ধরেননি সামসুল ইসলাম ভরসা।
এদিকে বিএসইসিও এখন পর্যন্ত অফিস দখলের বিষয়ে কিছু জানে না। প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম সাননিউজকে বলেন, এখন পর্যন্ত বিষয়টি আমাদের জানা নেই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৩ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া ফারইস্ট ফাইন্যান্স ২০১৮ সালের ১৯ এপ্রিল ‘জেড’ ক্যাটাগরিভুক্ত হয়। বিএসইসি সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সাল পর্যন্ত কোম্পানিটির সমন্বিত লোকসান হয়েছে ১৫২ কোটি ২২ লাখ টাকা। এর মধ্যে কেবল ২০১৯ সালেই লোকসান হয়েছে ৭১ কোটি ৮০ লাখ টাকা। কোম্পানি সংশ্লিষ্টদের ধারনা বর্তমানে কোম্পানিটির লোকসানের পরিমান প্রায় ২০০ কোটি টাকা।
বর্তমানে কোম্পানিটির স্পন্সর ডিরেক্টদের কাছে ৪১ দশমিক ৮৮ শতাংশ, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে ১১ দশমিক ৫৫ শতাংশ, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে ০.০৪ শতাংশ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে ৪৬ দশমিক ৫৬ শতাংশ শেয়ার রয়েছে।
সাননিউজ/আরএম/টিএস/এসএম