নিজস্ব প্রতিবেদক:
দেশে রিকন্ডিশন্ড বা পুরনো গাড়ির তুলনায় বাড়ছে নতুন গাড়ি আমদানির হার। রিকন্ডিশন্ড গাড়ি বিক্রি ও আমদানিতে নেমেছে ব্যাপক ধস। প্রতিনিয়তই বাড়ছে নতুন গাড়ির চাহিদা। এক দশকের মধ্যে নতুন গাড়ির চাহিদা বেড়েছে দ্বিগুনেরও বেশি। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাজারের বড় অংশই নিয়ন্ত্রণ করছে রিকন্ডিশন গাড়ি। কিন্তু তা আর বেশি দিন থাকবে না। গাড়ির বাজারের যে প্রবনতা তাতে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে নতুন গাড়ির বিক্রি ৫০ শতাংশে উন্নীত হবে বলে আশঙ্কা করছে তারা।
রিকন্ডিশন্ড গাড়ির নামে নিম্নমানের গাড়ি আমদানি, বড় ধরনের শুল্ক বৈষম্য, পুরনো গাড়ির অবচয় হার কমানো, ব্যাংক ঋণের অভাব, দুদক আতঙ্ক ও কালো টাকার অবাধ বিনিয়োগের কারণে অসম প্রতিযোগিতার মুখে রিকন্ডিশন্ড গাড়ি ব্যবসা সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে। বিপরীতে এক দশক আগে দেশের বাজারে নতুন গাড়ির চাহিদা ছিলো মাত্র ১০ শাতাংশ। ২০২০ সালে তা এসে দাঁড়িয়েছে ২০ শতাংশে। তারপরও দেশের গাড়ির বাজার নিয়ন্ত্রণ এই রিকন্ডিশন্ড গাড়ির দখলে। বাজারের প্রায় ৮০ ভাগ এখনও দখল করে আছে রিকন্ডিশন গাড়ির। তবে অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে দুইয়ের দামে পার্থক্য এখন সবচে কম।
এতদিন ক্রেতাদের অধিকাংশ সুলভ মূল্যের কারণে রিকন্ডিশন গাড়ি কিনতে চাইলেও দাম বাড়ার কারণে এখন তাদের প্রথম পছন্দ নতুন গাড়ি।
মোটরকার বিক্রয়কারীদের দেওয়া সামষ্টিক তথ্যে দেখা গেছে, গত তিন বছর ধরে দেশে রিকন্ডিশন গাড়ি বিক্রির সংখ্যা বেশ কমছে। যার বিপরীতে বাড়ছে নতুন গাড়ি বিক্রি। এই সময়টায় নতুন গাড়ি বিক্রি আগের তুলনায় বেড়েছে ৫৮ শতাংশ।
প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে ছিটকে পড়ছেন পুরনো গাড়ির অনেক আমদানিকারক ও উদ্যোক্তা। এছাড়া চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে গাড়ি আমদানি কমে যাওয়ায় ব্যাপক প্রভাব পড়ছে সরকারের রাজস্ব আদায়ের ওপর।
রিকন্ডিশন্ড গাড়ি ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ রিকন্ডিশন্ড ভেহিকেলস ইমপোর্টার্স অ্যান্ড ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বারভিডা) তথ্যানুযায়ী, আগে যেখানে মাসে গড়ে প্রায় ২ হাজার গাড়ি বিক্রি হতো সেখানে এখন নেমে এসেছে এক হাজার থেকে ১২শ গাড়িতে।
বারভিডা বলছে, চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর দিয়ে গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রিকন্ডিশন্ড গাড়ি আমদানি হয়েছে ২৩ হাজার ২৮৯টি। এর আগের অর্থবছরে আমদানি হয় ৩২ হাজার ৮২০টি গাড়ি। এক বছরের ব্যবধানে রিকন্ডিশন্ড গাড়ির আমদানি কমেছে প্রায় সাড়ে ৯ হাজার, যা মোট রিকন্ডিশন্ড গাড়ি আমদানির প্রায় ২৯ শতাংশ।
সংগঠনের সভাপতি আবদুল হক বলেন, রিকন্ডিশন্ড গাড়ির ব্যবসা থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) প্রতিবছর প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আহরণ করছে। অব্যবহৃত মোংলা বন্দর চালুকরণে ভূমিকা রেখেছেন রিকন্ডিশন্ড গাড়ির আমদানিকারক-উদ্যোক্তারা। জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখার পাশাপাশি ব্যাপকভাবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে এ খাতের মাধ্যমে।
কিন্তু পুরনো গাড়ির আমদানি শুল্ক বাড়িয়ে দিয়ে নতুন গাড়ির সঙ্গে বড় ধরনের শুল্ক বৈষম্য, সহজে ব্যাংক ঋণ না পাওয়া, পুরনো গাড়ির অবচয় হার কমানো চেষ্টা এবং নিম্নমানের গাড়ি আমদানির কারণে অসম প্রতিযোগিতার মুখে পড়েছে রিকন্ডিশন্ড গাড়ি ব্যবসা।
অন্যদিকে এখন হাতের নাগালের মধ্যে চলে এসেছে নতুন গাড়ির দাম। দামের ব্যবধান সামান্য থাকায় পুরোনো গাড়ির পরিবর্তে ভোক্তারা ঝুঁকছেন নতুন গাড়ির প্রতি।
নতুন গাড়ির ব্যবসায়ীরা জানান, রিকন্ডিশন গাড়ির তুলনায় নতুন গাড়ি আমদানি ও বিক্রি করা অনেকটাই ঝামেলা মুক্ত। জাপান থেকে নিলামে কেনা রিকন্ডিশন গাড়ি বিক্রি করার পর ত্রুটিপূর্ণ থাকে অনেক যন্ত্রপাতি। এতে ক্ষুব্দ হন ভোক্তারা। নতুন গাড়ি কিনে নিলে এ সমস্যটা থাকে না।
দেশের বাজারে ব্র্যান্ড নিউ টয়োটা গাড়ির একমাত্র আমদানিকারক নাভানা লিমিটিডের জ্যেষ্ঠ উপ-ব্যবস্থাপক মো. লুৎফুল করিম বলেন, দেশের মানুষের আর্থিক সক্ষমতা বাড়ার পাশাপাশি দাম হাতের নাগালে চলে আসায় মধ্যবিত্ত শ্রেণির চাকরিজীবীরাও এখন নতুন গাড়ি কিনছে। সব মিলিয়েই একটু বেশি টাকা খরচ করে হলেও টেকসই গাড়ির নিশ্চয়তা পেতেই বেশি আগ্রহী ভোক্তারা। তাই বাড়ছে নতুন গাড়ির চাহিদা।
এদিকে, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে গাড়ি আমদানি কমে যাওয়ায় সরকারের রাজস্ব আদায়ের ওপর পড়ছে ব্যাপক প্রভাব। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে গাড়ি আমদানির বিপরীতে রাজস্ব আদায় হয়েছিল এক হাজার ৮১৫ দশমিক ৬৫ কোটি টাকা। ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে রাজস্ব আদায় হয়েছে এক হাজার ৯৫৭ দশমিক ৬৪ কোটি টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরের শুরুতেও রাজস্ব আদায় নিম্নমুখী।
চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজের তথ্য মতে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মোট ১২ হাজার ৬২টি গাড়ি আমদানি হয়েছে। এর মধ্যে ব্রান্ড নিউ হাইব্রিড দুই হাজার ৯১০, রিকন্ডিশন্ড হাইব্রিড ৮৪, ব্রান্ড নিউ নন হাইব্রিড এক হাজার ৮৯৯, রিকন্ডিশন্ড নন হাইব্রিড সাত হাজার ১৬৯টি। এসব গাড়ি আমদানির বিপরীতে রাজস্ব আদায় হয়েছে এক হাজার ৮১৫ দশমিক ৬৫ কোটি টাকা।
চট্টগ্রাম কাস্টমসের কমিশনার মোহাম্মদ ফখরুল আলম বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে গাড়ি আমদানি কমেছে, তাই রাজস্ব আদায়ের হারও কমেছে। অনেক ব্যবসায়ী চট্টগ্রাম দিয়ে গাড়ি আমদানি করছেন না। তারা মোংলা বা অন্য বন্দর দিয়ে গাড়ি রিলিজ করাচ্ছেন, যা রাজস্ব আদায় কমার অন্যতম একটি কারণ।
সান নিউজ/সালি