নিজস্ব প্রতিবেদক : চীন-আমেরিকার বাণিজ্য যুদ্ধের টানাপোড়নে চীন থেকে ৮৭ জাপানী কোম্পানি বিনিয়োগ প্রত্যাহার করলেও বাংলাদেশে আসেনি একটি কোম্পানিও। তবে এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ বাংলাদেশে নিয়ে আসছে জাপান।
নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে সরাসরি এ বিনিয়োগ আসবে বলে সম্প্রতি জানিয়েছেন ঢাকায় নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি।
শুধু জাপান নয়, বাংলাদেশে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ নিয়ে আসছে চীন। চীনের শীর্ষস্থানীয় কোম্পানি ইয়াবাং ইনভেস্টমেন্ট হোল্ডিংস গ্রুপ বাংলাদেশে প্রাথমিকভাবে আড়াই হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে। বিনিয়োগের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরে ১০০ একর জমি নিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ইজারা চুক্তি করেছে বেজা।
এছাড়া চট্টগ্রামের আনোয়ারায় চীনা অর্থনৈতিক অঞ্চলে ৬০ চীনা কোম্পানি বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করে সেখান অবস্থিত চীনা প্রতিষ্ঠানের কাছে। সম্প্রতি বৈশ্বিক পরামর্শক সংস্থা প্রাইস ওয়াটার হাউস কুপারসের (পিডাব্লিউসি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনা মহামারীতে মন্দা কমানো, বেশির ভাগ কোম্পানি ব্যয় কমানো, মজুরি বাবদ ব্যয় কমানো, বাণিজ্যযুদ্ধ এড়ানো ও জমির ব্যয় কমানোর জন্য চীন ছাড়তে চায়।
জাপানের সনি কর্পোরেশন তাদের কারখানা চীন থেকে সরিয়ে অন্য কোন দেশে নিতে চায়। সম্প্রতি চীন ও আমেরিকার মধ্যকার বাণিজ্য যুদ্ধের কারনে চীন থেকে ৮৭ জাপানী কোম্পানি বিনিয়োগ তুলে নিয়ে থাইল্যান্ড, লাওস, ভিয়েতনাম, মিয়ানমার, মালয়েশিয়ার মতো দেশে গেলেও বাংলাদেশে আসেনি একটি কোম্পানিও।
তবে সম্প্রতি বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাত শেষে ঢাকায় নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি জানিয়েছেন, এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ আসছে বাংলাদেশের আড়াই হাজারের স্পেশাল ইকোনমিক জোনে। তিনি বলেন, জাপান-বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশে অটোমোবাইল কারখানা স্থাপনের চিন্তা করছে জাপান।
সরকার জাপানীদের জন্য একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করছে, যার ৫০০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। এটি করছে জাপানের সুমিতমো কর্পোরেশন। জাপানী অর্থনৈতিক অঞ্চল ২০২১ সালে কারখানা করার উপযোগী হবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)।
জাইকার সহায়তায় বিনিয়োগকারীদের জন্য এক দরজায় সেবা বা ওয়ান স্টপ সার্ভিসও চালু করেছে বেজা। বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম জেট্রোর ঢাকা কার্যালয়কে চিঠি দিয়ে বলেছেন, জাপান বিদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য আনার যে কৌশল নিয়েছে, তা নিয়ে বাংলাদেশ খুবই আগ্রহী।
এফবিসিসিআই চায়, জাপান কারখানা সরিয়ে বাংলাদেশে নিয়ে আসুক। চীন থেকে সরে যাওয়া কারখানা এ দেশে আনতে বাড়তি সুবিধা দেয়ার চিন্তা করছে সরকারও। এ জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি কমিটিও কাজ করছে।
চীনের শীর্ষস্থানীয় কোম্পানি পোশাক উৎপাদনের কাঁচামাল ও অন্যান্য রাসায়নিক কারখানা স্থাপনের জন্য প্রাথমিকভাবে ৩০ কোটি ডলার বা দুই হাজার ৫২০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে। পরে এই বিনিয়োগ এক বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে।
কোম্পানিটি বার্ষিক ইজারা ভাড়া ভিত্তিতে ১০০ একর জমিতে শিল্প স্থাপন করবে। মঙ্গলবার ( ১০ নভেম্বর) সকালে বেজা কার্যালয়ে এ সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এতে বার্ষিক রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৪৬ দশমিক ৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এছাড়া বার্ষিক অভ্যন্তরীণ বিক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৯৭ দশমিক ৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
এখানে স্থাপিত শিল্পে ২ হাজার ২শ লোকের কর্মসংস্থান হবে। চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব মোঃ তোফাজ্জল হোসেন মিয়া, গেস্ট অব অনার হিসেবে চীনে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোঃ মাহবুব উজ জামানি উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন ইয়াবাং গ্রুপের চেয়ারম্যান মিস্টার জুজিয়াচু। চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী।
ইয়াবাং ইনভেস্টমেন্ট হোল্ডিংস গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড একটি চীনা সংস্থা যা মূলত চীনের ইয়াবাং গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত। তারা ডাইং ও পেন্টিং-এর ক্ষেত্রে অন্যতম বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান। এই গ্রুপটি জিয়াংসু স্টক এক্সচেঞ্জের একটি তালিকাভুক্ত সংস্থা। ডাই ও রং ছাড়াও পিগমেন্ট, ফার্মাসিউটিক্যালস, ভেটেরিনারি ওষুধ, কীটনাশক, ফটোভোলটাইকস, মাইনিং, লজিস্টিক্স, ফিনান্স এবং রিয়েল এস্টেটের সেক্টরে তাদের বিনিয়োগ রয়েছে।
ইয়াবাং গ্রুপের বার্ষিক পরিচালন আয় ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই গ্রুপটি শীর্ষস্থানীয় ৫শ চীনা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে।
বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী বলেন, দেশে বাণিজ্য ও বিনিয়োগে সুদিন আসছে। বিদেশী বিনিয়োগের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে কাজ করছে বেজা। এর ধারাবাহিকতায় জাপান, ভারত ও চীনসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। করোনা দুর্যোগের সময় সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ নিয়ে আসছে চীনের ইয়াবাং গ্রুপ। নতুন এই বিনিয়োগে দেশের রফতানির বাজারে বৈচিত্র্য আসবে।
পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ কর্তৃপক্ষ (পিপিপিএ) মডেলের অধীনে বিদেশের বেসরকারী বিনিয়োগ বাড়াতে চায় সরকার। এরই অংশ হিসেবে চলমান প্রকল্পগুলো যাচাই-বাছাইয়ের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব আহমদ কাইকাউসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত পিপিপিএ-এর বোর্ড সভায় এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
সভায় জানানো হয়, ইতোমধ্যে বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ করার সম্ভাবনা নিয়ে তৈরি করা হয়েছে বেশ কিছু আকর্ষণীয় ও পরিকল্পিত প্রকল্প। এ কারণে নতুন করে পিপিপি মডেলের প্রকল্প হাতে নেয়ার আগে আরও সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এছাড়া, যে সব প্রকল্পের বাস্তবতা ও বিপণনযোগ্যতা বিবেচনা না করেই তালিকাভুক্ত করা হয়েছে, সেগুলো যাচাই-বাছাই করতে বলা হয়েছে সভায়।
সান নিউজ/এসএ