সান নিউজ ডেস্ক : স্বপ্ন ছিল ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার, বুয়েটে পড়তে চেয়েছিলেন। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার কারণে তা হয়ে ওঠেনি। কখনো পারিবার কখনো বা সমাজ থেকে পদে পদে ধাক্কা খেতে হয়েছে। পৌঁছাতে পারেননি নিজের কাঙ্ক্ষিত লক্ষে। তবু লেগে ছিলেন আব্দুল্লাহ আল মামুন। তিনি ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (ডুয়েট) এর কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগের ৮ম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন।
আরও পড়ুন : নির্মাণ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে ছবি তুলবেন প্রধানমন্ত্রী
ঐতিহ্যবাহী বগুড়া জেলার শেরপুর উপজেলার এই তরুণ সম্প্রতি সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার (মেশিন লার্নিং) হিসেবে যোগ দিয়েছেন বিশ্বের সর্ববৃহৎ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের মূল প্রতিষ্ঠান মেটা ইনকরপোরেশনে।
ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল্লাহ আল মামুনের প্রত্যাশিত সফলতা প্রাপ্তির হার না মানা গল্প সান নিউজের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।
কিশোর বয়সে অনেকেরই স্বপ্ন থাকে বুয়েটে পড়ার, ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার। আমিও এর ব্যতিক্রম ছিলাম না। তবে এ ক্ষেত্রে বড় বাধা ছিল আমার অসুস্থতা। বছরের অর্ধেক সময় অ্যাকিউট অ্যাজমা আর বাতজ্বরে ভুগতাম।
ফলে মাধ্যমিকের রেজাল্ট বাজে হলো। তবু পরীক্ষা দিয়েছিলাম দেশের সেরা কিছু কলেজে। কিন্তু চান্স পেলাম না কোথাও। তখন মনে হলো, আমি শুধু শারীরিকভাবেই দুর্বল না, মেধায়ও। শেষে ভর্তি হলাম বগুড়া পলিটেকনিকে, তাও যদি ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন পূর্ণ হয়! সেই সময় পলিটেকনিক থেকে ডিপ্লোমা পাস করে শুধু ডুয়েটেই (ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়) বিএসসি করার সুযোগ ছিল।
পলিটেকনিকের পাঠ চুকিয়ে বন্ধুরা মিলে কোচিংয়ে ভর্তি হলাম। কী একটা কারণে ওই বছর (২০০৭ সাল) ডুয়েট অ্যাডমিশন টেস্ট বাতিল হয়। আশাহত হয়ে অনেকেই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে গেল। তবে আমার কাছে ডুয়েটই ছিল একমাত্র অপশন! পরের বছর ডুয়েটে ভর্তি পরীক্ষা দিলাম। সুযোগ পেলাম কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে।
আরও পড়ুন : অস্ত্রধারীদের হামলায় নিহত ১০০
দুই নৌকায় পা
বিশ্ববিদ্যালয়ে চতুর্থ বর্ষে এসে মাথায় বিভিন্ন চিন্তা উঁকি দিতে শুরু করল। আমার রুমমেট জিআরই আর টোফেল নিয়ে পড়াশোনা করত। ওকে দেখে মনে হতো, ইশ! আমিও যদি আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা নিয়ে ক্যারিয়ার গড়তে পারতাম। এই ভাবনা থেকেই চতুর্থ বর্ষের থিসিসের সময়টায় জিআরই দিতে লাগলাম।
দুই নৌকায় পা দিতে গিয়ে থিসিসে রেজাল্ট খারাপ আসায় সিজিপিএ কমে গেল। ওদিকে জিআরইতেও অবস্থা শোচনীয়। গণিত ও ইংরেজিতে দুর্বলতার কারণে ১৬০০ নম্বরের মধ্যে পেলাম মাত্র ৯৫০। এই রেজাল্টে ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া তো দূরের কথা, আবেদনই করতে পারব না।
আরও পড়ুন : সাড়ে ১৭ হাজার কোটি টাকার সম্পূরক বাজেট পাস
হাল ছাড়িনি
ওই সময় স্বল্প বেতনে একটি সফটওয়্যার কম্পানিতে যোগ দিলাম। কাজের ফাঁকে আইইএলটিএসের প্রস্তুতিও নিতে থাকি। তবে মাত্র ৬.৫ স্কোর তুলতেই আমাকে দুবার পরীক্ষা দিতে হয়েছিল। তখন আমেরিকার ভাবনা ঝেড়ে ফেলে চিন্তা করতে লাগলাম জিআরই ছাড়া কোন কোন দেশে যাওয়া যায়। জার্মানির একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পেয়েও কাজে লাগাতে পারিনি। কারণ সেখানে পড়তে অনেক টাকার প্রয়োজন। ইউরোপ ও ইউরোপের বাইরে দুদিকেই চেষ্টা করতে শুরু করি। ২০১৪ সালে হঠাৎ একদিন ই-মেইল পেলাম সৌদি আরবের কিং ফাহাদ ইউনিভার্সিটি থেকে। শর্ত সাপেক্ষে তারা ভর্তি করাতে চায়। শর্ত হিসেবে আমাকে আবার জিআরই দিতে হবে। তবে আবার জিআরই দেওয়ার ইচ্ছা ছিল না। ফিরতি ই-মেইলে তা জানিয়ে দিলাম। এবার তারা জানাল জিআরই না দিলে প্রথম সেমিস্টারে অন্তত ৩.৫-এর ওপর সিজিপিএ রাখতে হবে।
আরও পড়ুন : সক্রিয় জুয়া চক্রের সন্ধান
অবশেষে স্বপ্নের আমেরিকায়
মাস্টার্সের শেষ দিকে ব্যস্ততা ছিল অনেক। সৌদিতে সামার সিজনে দীর্ঘ ছুটি থাকে। তখন বিদেশি শিক্ষার্থীরা নিজ দেশে ঘুরতে যায়। তবে দেশে না গিয়ে সেই ছুটিতে আবার জিআরইর প্রস্তুতি নিলাম, সঙ্গে থিসিসের কাজ এগিয়ে রাখলাম। ছুটিতে সবাই বাড়ি গেলে হোস্টেলে আমি একা হয়ে গেলাম। আমার থিসিসের টপিক ছিল রোবটিকস। রোবট নিয়ে কাজ করতে করতে তখন নিজেও যেন রোবট হয়ে পড়েছিলাম। কিছুদিন পর জিআরইর রেজাল্ট দিল। এবার আবেদন করার মতো স্কোর পেলাম।
২০১৭ সালের দিকে কাতার ইউনিভার্সিটিতে টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্ট পদে চাকরির সুযোগ পাই। সেখানে থেকেই বেছে বেছে পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করলাম। মাস তিনেক পর দুটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শত ভাগ স্কলারশিপের অফার পেলাম। এর মধ্যে বেছে নিলাম ফ্লোরিডা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, চলে এলাম মার্কিন মুলুকে।
আরও পড়ুন : সাবেক এমপি’র বাড়িতে হামলা
প্রশ্নই তো বুঝি না
কম্পিউটার সায়েন্স পড়লেও কোডিংয়ে দুর্বল ছিলাম। আমেরিকা আসার পর একবারে জিরো থেকে কোডিং অনুশীলন শুরু করলাম। কিন্তু লিটকোডের সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে দেখি এদের প্রশ্নই আমি বুঝি না। এ রকমও দিন গেছে গোটা দিনে সহজ একটি সমস্যার সমাধানও করতে পারিনি।
প্রতিদিন ল্যাবের কাজ শেষ করে রাতে এসে অনুশীলন করতাম। এভাবে কয়েক মাসেই কোডিং ধরা দিতে শুরু করে। বুঝলাম এবার হয়তো কিছুটা হলেও টেক জায়ান্টদের চাহিদামতো প্রস্তুত আমি। সার্কুলার দেখে আবেদন করতে শুরু করলাম বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। তবে এসব জায়গায় ইন্টারভিউতে ডাক পাওয়া কঠিন।
আরও পড়ুন : ৩৬ কিলোমিটার দৌড়ে প্রথম
হতাশা ঘিরে ধরেছিল
কয়েক শ আবেদনের পর বুঝলাম আমার বায়োডাটা ও লিংকডইন প্রফাইলে ঘাটতি আছে। বড় বড় প্রতিষ্ঠানে ইন্টারভিউতে ডাক পেতে সবচেয়ে সহজ পথ হলো বর্তমান জব হোল্ডারের রেফারেন্স নেওয়া। চেষ্টা করলাম এই ঘাটতিগুলো পূরণের। তবে মেটায় আমাকে কেউ রেফার করেনি।
প্রথম ডাক পেয়েছিলাম ইনটেল থেকে। দুই রাউন্ড ইন্টারভিউ শেষে চূড়ান্ত রাউন্ডে বাদ পড়ি। এরপর ছোটখাটো সব কম্পানিতে আবেদন করতে থাকি। ইন্টারভিউয়ের ডাক পেলাম লিংকডইন, টেসলা, উবারসহ আরো অনেক জায়গা থেকে।
তবে আবারও সব জায়গা থেকে রিজেক্ট! তখন আমার পিএইচডি থিসিস আর ইন্টারভিউ দুটোই চলছিল একসঙ্গে। বিভিন্ন জায়গা থেকে ফিরিয়ে দেওয়ার পর মানসিকভাবে এক প্রকার বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছিলাম।
আরও পড়ুন : গুয়েতেমালায় বৃষ্টিপাতে নিহত ১৫
সাত পর্ব পেরিয়ে
পিএইচডিতে আমার গবেষণার বিষয় ছিল মেশিন লার্নিংয়ের মাধ্যমে মানুষের রোগ নির্ণয়ের আদ্যোপান্ত নিয়ে। পিএইচডি ডিফেন্সের কিছুদিন পরেই মেটায় ইন্টারভিউয়ের ডাক পাই। ফেসবুকে আমার ইন্টারভিউ ছিল সাত পর্বের।
প্রথম পর্বে চাকরির অভিজ্ঞতা নিয়ে কথা হয়। ভবিষ্যতে ফেসবুকের জন্য আমার পরিকল্পনা কী বা কী ধরনের কাজ করতে পছন্দ করি—এসবও জানতে চায়। পরের রাউন্ডটি ফোন স্ক্রীন রাউন্ড। এখানে দুটি লিটকোড-এর সমস্যা সমাধান করতে হয় মাত্র ৩৫ মিনিটে। ইন্টারভিউর এক দিন পরই জানানো হয় এই রাউন্ডগুলোতে উত্তীর্ণ হয়েছি। চূড়ান্ত পর্ব মোট পাঁচ ভাগে বিভক্ত।
প্রথমেই বিহেভিয়র রাউন্ড। এই পর্বে ব্যক্তিগত দক্ষতা সম্পর্কিত প্রশ্ন করা হয়। এরপর ফার্স্ট কোডিং রাউন্ড ও সেকেন্ড কোডিং রাউন্ড। এ দুটি রাউন্ড ফোন স্ক্রীন রাউন্ড-এর মতো। পরেরটি সিস্টেম ডিজাইন। এই রাউন্ডে মূলত হাই স্কেল ডিস্ট্রিবিউটেড সিস্টেম কিভাবে তৈরি করা হয় তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়।
যেমন—রাইড শেয়ারিং সিস্টেম (উবার) অথবা জনপ্রিয় মেসেজিং সিস্টেম (হোয়াটসঅ্যাপ) ডিজাইন করতে বলা হতে পারে। মাত্র ৩৫ মিনিটে পুরো সিস্টেমটির একটি ব্লু প্রিন্ট দাঁড় করাতে হবে এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিল্ডিং ব্লক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করতে হবে।
এরপর মেশিন লার্নিং রাউন্ড। এটিই সবচেয়ে কঠিন। এই রাউন্ডে বাস্তব জীবনের একটি সমস্যা মেশিন লার্নিং ব্যবহার করে সমাধান করতে হয়। যেমন—ইউটিউবের ভিডিও রিকমেন্ডেশন সিষ্টেম তৈরি অথবা ফেসবুকে কোন অ্যাডটি কোন ইউজারকে দেখাতে হবে সেটির ডিজাইন করা। এই পর্বে মূলত মেশিন লার্নিংয়ের তাত্ত্বিক ও ব্যাবহারিক জ্ঞান কতটুকু তা যাচাই করা হয়।
আরও পড়ুন : কাউন্সিলরকে হত্যার হুমকি
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়েই কাজ
কিছুদিন পরই মেটা থেকে জানানো হয় ই-ফোর সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে নির্বাচিত হয়েছি। ই-ফোর ইঞ্জিনিয়াররা মূলত প্রোগ্রাম ডিজাইন ও সিস্টেম ডিজাইনের কাজ করেন। মেটায় আমার কাজ মেশিন লার্নিং নিয়ে। মেশিন লার্নিং মানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স।
এ ক্ষেত্রে যেকোনো সিস্টেমকে এমন একটি ক্ষমতা তৈরি করে দেওয়া হয়, যাতে সেটি কোনো কাজ কোনো প্রকার পূর্ব প্রোগ্রামিং ছাড়াই নিজে নিজে করতে পারে। যেমন ধরুন, অনেক সময় ব্যবহারকারীদের কেউ কেউ ফেসবুকে ধর্মীয় বিদ্বেষ বা বর্ণবিদ্বেষমূলক পোস্ট দেয়। রিপোর্ট পেলে তখন ফেসবুক এদের আইডি সাময়িক সময়ের জন্য বন্ধ রাখাসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা নেয়।
কোটি কোটি ফেসবুক গ্রাহকের এত পোস্ট দেখা ফেসবুকের ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। সে জন্য তাঁরা মেশিন লার্নিং টুল ডেভেলপ করে রাখেন। এই পদ্ধতিতে ধর্মীয় বা বর্ণবিদ্বেষ ছড়ানো আইডি অটোমেটিক রেস্টিকটেড করে রাখা যায়। মেটায় সবে আমার পথচলা শুরু হয়েছে। সামনে অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে।
সান নিউজ/এইচএন