নিজস্ব প্রতিবেদক:
ফরিদপুর: বিশ্বের জনপ্রিয় ফুটবল ক্লাব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে (ম্যানইউ) প্রশিক্ষণ পেয়েও বড় ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন ভাঙতে বসেছিল রিপন কুমার দাসের। জীবনের তাগিদে পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজ করতে বাধ্য হওয়া সেই রিপন ফের মাঠ দাঁপিয়ে বেড়ানোর সুযোগ পেতে যাচ্ছেন। তাকে ক্রীড়াঙ্গনে সম্মানজনক পেশায় ফিরিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক অতুল সরকার। বৃহস্পতিবার (১৬ জুলাই) পরিবারের ভরণ-পোষনে তাকে ১০ হাজার টাকাও দিয়েছেন।
অভাবের সংসার চালাতে প্রতিদিন ভোরে ঝাড়ু হাতে রাস্তা পরিস্কারে নামা রিপনের বাড়ি ফরিদপুর শহরের কুঠিবাড়ী এলাকায়। তার বাবা ছিলেন ফরিদপুর সড়ক বিভাগের পরিচ্ছন্নতাকর্মী। তার স্থলেই ফুটবল মাঠ ছেড়ে এ কাজে নামতে বাধ্য হন রিপন।
অথচ অল্প বয়সেই পায়ের নৈপুণ্যে নজর কেড়েছিলেন শৈশব থেকেই গ্রামের মাঠে ফুটবল খেলা রিপন। পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধবদের উৎসাহে ধীরে ধীরে ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন দানা বাঁধে বুকে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১২ সালে মুঠোফোন কোম্পানি এয়ারটেলের (বর্তমানে রবি আজিয়াটা লিমিটেড) প্রতিভা অন্বেষণ কর্মসূচির প্রতিযোগিতায় নাম লেখান। অনন্য প্রতিভায় রাইজিং স্টার চ্যাম্পিয়ন নির্বাচিতও হয়ে যান। সেবার যে ১২ জন ফুটবলার ম্যানচেস্টারে প্রশিক্ষণ নেওয়া ও অনুশীলনের সুযোগ পেয়েছিলেন, তাদেরই একজন এই মিডফিল্ডার। সারা দেশের ৬০ হাজার ছেলের মধ্যে বাছাই করে ওই ১২ জনকে নেওয়া হয়েছিল। ওই দলের সঙ্গে ১৭ নভেম্বর ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ক্লাবে অনুশীলনের জন্য যান রিপন। সেখানে দশদিনের অনুশীলন ও প্রশিক্ষণ শেষ করে ফিরে আসেন দেশে।
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড এভাবেই তার বড় খেলোয়াড় হওয়ার স্বপ্নকে আরও উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিল । দেশে ফিরে ২০১৪ সালে আবাহনী অনূর্ধ্ব-১৬ দলের হয়ে খেলেছিলেনও রিপন। এরপর তৃতীয়, দ্বিতীয় ও প্রথম বিভাগ হয়ে গত বছর খেলেন বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে। কিন্তু প্রতিভা বিকাশে যে রকম ভালো কোচের অধীনে তার খেলার দরকার ছিল, পাননি সে রকম কাউকে। বাফুফের তদারকির অভাবে নিজ জেলা ফরিদপুরে ফিরে আসতে হয়।
ফরিদপুরে এসেও জীবনের কঠিন বাস্তবতায় ফুটবল খেলার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়। সংসারের অভাব-অনটনের কারণে বাবার কর্মস্থল ফরিদপুর সড়ক বিভাগে মাস্টাররোলে পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজে যোগ দেন তিনি।
বেশ কিছুদিন ধরে ফরিদপুর সড়ক বিভাগে এ কাজ করছেন রিপন। তারপরও প্রতিদিনের রুটিন কাজ শেষে সুযোগ করে ঠিক ফুটবল নিয়ে নেমে পড়েন মাঠে।
ফরিদপুর জেলা ফুটবল টিমের কোচ প্রণব কুমার মুখার্জি বলেন, ‘রিপনের ফুটবলের প্রতি বিশেষ প্রেম রয়েছে। যে কারণে অফিসের পরিচ্ছন্নতার কাজ শেষে সুযোগ পেলেই অনুশীলন করতে স্টেডিয়ামে চলে আসেন। এখনো তার ইচ্ছা দেশসেরা ফুটবলার হওয়া।’
ফরিদপুর ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম ভোলা বলেন, ‘রিপনের মতো ফুটবলার তৈরি হয় খুব কম। বাফুফে যদি সঠিকভাবে ভূমিকা নিত তাহলে তাকে এভাবে ঝড়ে পড়তে হতো না। এখনো তার অনেক সুযোগ রয়েছে।’
ফুটবলার রিপন কুমার দাস বলেন, ‘সংসারের আর্থিক অভাব-অনাটনে আমি এখন পরিচ্ছন্নতাকর্মী। বাবা-মায়ের কষ্টের কথা চিন্তা করেই এ কাজ করছি।’
বড় ফুটবলার হতে চেয়েছিলেন জানিয়ে রিপন বলেন, ‘সংসারের দৈন্যদশা কাটানোর চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু পেরে উঠিনি। সরকার যদি আমার বিষয়টি দেখে, তাহলে হয়তো আমি আবারও বল নিয়ে মাঠে দর্শকদের মনজয় করতে পারবো।’
‘ইংল্যান্ডে যাওয়ার পরে সে দেশের নামকরা ফুটবল তারকারা আমাদের সময় দিয়েছেন। দেখিয়েছেন কীভাবে আরও ভালো ফুটবল খেলা যায়। ফুটবল খেলার মান কীভাবে আরও উন্নত করা যায়। কিন্তু সেই প্রশিক্ষণকে কাজে লাগাতে পারিনি’- বলেন নিজের আক্ষেপের কথা।
রিপনের মা পান্তা দাস বলেন, ‘আমার দুই ছেলের মধ্যে রিপন সবার বড়। ছোট ছেলে তপন এখনও কিছু করে না। শুধু সংসারের অভাবের কারণে তাকে ওর বাবার পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজ বেছে নিতে হয়েছে। এতে আমাদের খারাপ লাগলেও কিছু করার নেই। রিপন যদি আয় রোজগার না করতে পারে, তাহলে আমাদের যে না খেয়ে থাকতে হবে।’
তবে বিষয়টি জানতে পেরে জেলা প্রশাসক অতুল সরকার তাকে আর্থিক সহায়তা দিয়েছেন। একইসঙ্গে তাকে ক্রীড়াঙ্গনে সম্মানজনক পেশায় যুক্ত করাসহ খেলাধুলায় ফিরিয়ে দিতে সর্বাত্মক উদ্যোগ নেবেন বলে জানান। এতেই পুরোনো স্বপ্ন ফের দানা বাধছে রিপনের বুকে। আবারও ফুটবল মাঠ আর ক্রীড়াঙ্গনে ফেরার সম্ভাবনায় জেলা প্রশাসককে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন রিপন।
সান নিউজ/ এআর