নিজস্ব প্রতিবেদক: বয়স এবং পারিবারিক প্রতিবন্ধকতা যে কারোর প্রতিভাকে দমিয়ে রাখতে পারে না তার উত্তম উদাহরণ ৪৮ বছর বয়সী শাম্মী নাসরিন। তিন সন্তানের জননী এই এথল্যাট পাওয়ারলিফটিং খেলায় তৃতীয় স্থান অর্জন করেছেন নিজের সন্তানের বয়সী মেয়ে প্রতিযোগীদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। বাংলাদেশ পাওয়ারলিফটিং অ্যাসোসিয়েশন থেকে শাম্মী এ প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলেন।
খেলায় জিতে যাওয়ার পর অন্য প্রতিযোগীরা ফেসবুকে তাকে আন্টি সম্বোধন করেই শুভকামনা জানিয়েছেন। আর নিজের সন্তানরা মাকে নিয়ে গর্ব করে পোস্টও দিয়েছেন ফেসবুকে। শাম্মীর এক ছেলে বিয়ে করেছেন গত বছর। আরেক ছেলের বিয়ে আগামী নভেম্বরে। এক মেয়ে পড়ছে অষ্টম শ্রেণিতে।
বয়স ও নানা প্রতিকূলতাকে বুড়ো আঙুল দেখানো এই শাম্মী হয়ে উঠেছেন এখন সবার কাছে অনুপ্রেরণার অন্য নাম। অ্যাসোসিয়েশনটি বাংলাদেশ পাওয়ারলিফটিং ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশিপ ২০২০ শাম্মীকে উদাহরণ হিসেবে দেখিয়ে অন্যদের প্রতিযোগিতায় নাম নিবন্ধনের জন্য আহ্বান জানিয়েছে।
পাওয়ারলিফটিং মূলত একটি শক্তির খেলা, যা তিনটি লিফটে সর্বোচ্চ ওজনের তিনটি প্রচেষ্টা নিয়ে গঠিত। যেমন স্কোয়াট, বেঞ্চ প্রেস এবং ডেড লিফট। সহজ করে বললে খেলাটি ভারোত্তোলন খেলার মতো। তবে এতে স্কোয়াট মানে ঘাড়ে, বেঞ্চ প্রেস মানে শুয়ে বুকের ওপর এবং ডেডলিফট মানে মাটি থেকে ওজন তুলতে হয়। এই তিনটির স্কোরের ভিত্তিতে প্রতিযোগীকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। শাম্মী এই তিনটিতে প্রায় ২৭০ কেজি ওজন তুলেছেন।
শাম্মী জানালেন, নিজের শরীর ঠিক এবং ফিট রাখার জন্যই পাঁচ থেকে ছয় বছর আগে ছেলের সঙ্গে জিমে গিয়ে ব্যায়াম করা শুরু করেছিলেন। এর মধ্যে ছেলে জিমে যাওয়া বাদ দিলেও তিনি তা ধরে রেখেছেন। সংসারের প্রায় সব কাজ নিজের হাতে করি। তাই জিমে যাওয়ার নির্দিষ্ট কোনো সময় নেই। কাজ শেষ করেই ছুটি জিমে। প্রতিদিন প্রায় দুই ঘণ্টা জিমে কাটাই। অন্য সময়টুকু পরিবারের সবার জন্য ব্যয় করলেও জিমের সময়টুকু শুধুই আমার নিজের সময়।
জিমে যাওয়ার ব্যাপারে তিনি বলেন, এখন জিমে না গেলে ভালোই লাগে না। বাসায় থাকলেও ছাদে যতটুকু সম্ভব ব্যায়াম করি। স্বামীও জিমে ভর্তি হয়েছিলেন, সাত দিনের বেশি টিকতে পারেননি। তবে তার সুস্থতার জন্যই তাকে ব্যায়াম করার পরামর্শ দিই।
শাম্মীর ছোট ছেলে সাজিদ ইকবাল বললেন, আমরা আম্মুকে নিয়ে খুব গর্ব করি। তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন বয়স কোনো বিষয় নয়। আমি ফুটবল খেলে দেশ–বিদেশে বেশ কিছু পুরস্কার পেয়েছি। ফিট থাকার জন্যই আমার সঙ্গে জিমে যাওয়া শুরু করেছিলেন মা। আমি জিম ছেড়ে দিলেও মা ছাড়েননি। তারপর তো মা প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হলেন। বড় ছেলে তানভীর ফয়সল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করেছেন। একমাত্র মেয়ে হৃদিশা মৌরিন অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী।
বাংলাদেশ পাওয়ারলিফটিং অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি জেনারেল মোমিনুল হক জানালেন, করোনার আগে অ্যাসোসিয়েশনের ১৫০ খেলোয়াড়ের মধ্যে নারী ছিলেন ৩০ জনের মতো। দুই থেকে তিনজনের বয়স ৪০ বছর বা তার বেশি। বললেন, শাম্মী নাসরিন ২০১৯ সালে প্রথম প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। তার পরের বছর বিজয়ী হলেন। ২০১৯ সালে প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিলেন শায়লা শিমু, তখন তাঁর বয়স ছিল ৪০ বছর।
শাম্মীর গ্রামের বাড়ি পিরোজপুরে। এখানেও রয়েছে সামাজিক প্রতিবন্ধকতা। তিনি বলেন, আগে মহল্লায় মেয়ে হিসেবে সন্ধ্যার পর হাঁটা যেত না। আর এখন ছেলেমেয়ে একসঙ্গে জিম করছে। চারপাশের মানুষের মনমানসিকতায় পরিবর্তন এসেছে। যেকোনো বয়সী মেয়ে বা নারীদের যেকোনো কাজের জন্য ইচ্ছাশক্তি, মনোবল আর পরিবারের সহায়তা—এই তিনটাই সব থেকে জরুরি প্রয়োজন।
মেয়ে বললেন, জিমে এবং অ্যাসোসিয়েশনে প্রায় সবাই আমাকে মায়ের মতো ভালোবাসে, সম্মান করে। আমিও সবার সঙ্গে খুব আন্তরিক ব্যবহার করি।
নিজের ব্যাপারে তিনি জানান, আমার এনার্জি লেভেল খুব ভালো। ওজন তোলা দেখে জিমের মালিক কাজী এবাদত হোসেন নিজেই আমাকে পাওয়ারলিফটিং অ্যাসোসিয়েশনে নাম নিবন্ধন করিয়ে দেন। তারপর প্রথম প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে ভালোই করেছিলাম, তবে প্রথম তিন বা পাঁচজনের মধ্যে থাকতে পারিনি। গত বছর অংশ নিয়ে তৃতীয় হই।
মোমিনুল হক আশাবাদ ব্যাক্ত করে বলেন, অ্যাসোসিয়েশনটিকে ফেডারেশন করার জন্য সরকারের অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। এখন প্রতিযোগীরা বিভিন্ন জিমে প্র্যাকটিস করে পরে প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। সরকারের অনুমোদন পাওয়া গেলে পাওয়ারলিফটিং খেলোয়াড়দের জন্যই আলাদা একটি জিম গড়ে তোলা হবে।
সান নিউজ/এফএইচপি