ক্রীড়া ডেস্ক : আর্জেন্টাইন মহানায়ক। ফুটবল দক্ষতায় তর্কসাপেক্ষে সর্বকালের সেরা খেলোয়াড়। ফুটবল বিশ্বের কিংবদন্তী তিনি। কেবল খেলা নয়, খেলার বাইরেও নানা ঘটনা-অঘটনায় বারবার হয়েছেন সংবাদ শিরোনাম। এবার সব বিতর্ক-আলোচনা-শিরোনামের ঊর্ধ্বে উঠে গেলেন তিনি। ৬০ বছর বয়সে এসে না ফেরার দেশে পাড়ি জমালেন ‘ফুটবল ঈশ্বর’ দিয়াগো ম্যারাডোনা।
বুধবার (২৫ নভেম্বর) হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হলে জীবনাবসান ঘটে বিশ্বকাঁপানো এই বর্ণিল চরিত্রের। আর্জেন্টাইন শীর্ষ গণমাধ্যম ক্ল্যারিনসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যম তার মৃত্যুর খবর জানিয়েছে।
খবরে প্রকাশ, কিছুদিন আগে মস্তিষ্কে রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়ায় হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল ম্যারাডোনাকে। অস্ত্রোপচারের পর সপ্তাহ দুয়েক আগে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছিলেন তিনি। পুরোপুরি সেই অসুস্থতা থেকে সেরে ওঠার আগেই হার্ট অ্যাটাক হয়েছে তার। তাতেই ফুটবল বিশ্বকে কাঁদিয়ে শেষ বিদায় জানিয়ে দিলেন ম্যারাডোনা।
আর্জেন্টাইনদের কাছে ফুটবল মানেই এক আবেগের নাম। সেই আবেগের পূর্ণতা এসেছিল যে ব্যক্তিটির হাত ধরে, তিনি দিয়াগো ম্যারাডোনা। ১৯৮৬ সালে ২৬ বছর বয়সী ম্যারাডোনার হাতে ছিল অধিনায়কের আর্ম ব্যান্ড। সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া যাকে বলে, তার সাক্ষাৎ উদাহরণ হয়েছিলেন সে বছরের বিশ্বকাপের আসরে। পায়ের জাদুতে গোটা বিশ্বকে মুগ্ধ করে জিতে নিয়েছিলেন গোল্ডেন বল। তবে ব্যক্তিগত এই অর্জন নয়, সেবার দল হিসেবে আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপে জিতিয়েই ম্যারাডোনা হয়ে যান আর্জেন্টাইনদের নয়নের মনি।
ফকল্যান্ড যুদ্ধ ঘিরে ঘটনাবহুল সেই বিশ্বকাপেই আর্জেন্টিনা-ইংল্যান্ড মহারণে গোলশূন্য প্রথমার্ধের পর দ্বিতীয়ার্ধে আর্জেন্টিনাকে গোল উপহার দিয়ে উল্লাসে ভাসিয়েছিলেন ম্যারাডোনা। রিপ্লেতে সেই গোলে হাতের স্পর্শ পাওয়ার পর সেটি ‘দ্য হ্যান্ড অব গড’ হিসেবে খ্যাতি লাভ করে সারা দুনিয়ায়।
‘দ্য হ্যান্ড অব গড’ নিয়ে যত বিতর্কই থাকুক না কেন, সব বিতর্কের অবসান ওই ম্যাচেই করে দেন ম্যারাডোনা। নিজেদের অর্ধ থেকে বল নিয়ে একে একে ইংল্যান্ড দলের পাঁচ পাঁচ জন খেলোয়াড়কে (পিটার বেয়ার্ডসলি, স্টিভ হজ, পিটার রেইড, টেরি বাচার ও টেরি ফেনউইক) কাটিয়ে পৌঁছে যান ইংলিশ গোল পোস্টের সামনে। গোলরক্ষক পিটার শিলটন ছিলেন সামনে। তাকেও কাটিয়ে বল পৌঁছে দেন ইংলিশদের জালে। ফুটবলের ইতিহাসের সেরা গোল যে সেটিই— তা নিয়ে আপত্তি করার মতো মানুষ খুব কমই রয়েছেন।
১৯৯০ সালের বিশ্বকাপে গোড়ালির ইনজুরি থাকলেও পায়ের জাদুতে মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন তিনি। প্রথম পর্বের নাজুক সূচনার পরও শেষ পর্যন্ত দলকে ফাইনালে টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন। ফাইনালে প্রতিপক্ষ ছিল পশ্চিম জার্মানি। ৮৪ মিনিট পেরিয়ে যাওয়া ম্যাচটি গোলশূন্য ড্রয়ের মাধ্যমে টাইব্রেকারের দিকেই যাচ্ছিল। ৮৫ মিনিটে পশ্চিম জার্মানির স্ট্রাইকার রুডি ভোলারকে ফাউল করার জের ধরে রেফারি পেনাল্টির বাঁশি বাজান। সেই পেনাল্টি থেকে আন্দ্রেয়াস ব্রাহমে গোল করলে ওই একমাত্র গোলেই ফাইনাল জিতে নেয় পশ্চিম জার্মানি। আর্জেন্টিনা তো বটেই, ফুটবল ভক্তদের বড় একটি অংশেরই দাবি, ওই পেনাল্টিটি ছিল বিতর্কিত।
এরপর ১৯৯৪ সালের ফুটবল বিশ্বকাপেও অংশ নিয়েছিলেন আর্জেন্টাইন ফুটবলের মহানায়ক। কিন্তু দুইটি ম্যাচে অংশ নেওয়ার পরই ডোপ টেস্টে পজিটিভ ধরা পড়লে বিশ্বকাপ থেকে বহিষ্কৃত হতে হয় তাকে। বিশ্বকাপের পর ১৭ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারেরও সমাপ্তি টানেন ম্যারাডোনা।
খেলোয়াড়ি জীবন শেষ করার পর জাতীয় দলেও বছর দুয়েক কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ম্যারাডোনা। কোচ হিসেবে ২০১০ বিশ্বকাপেও দলকে নিয়ে যান তিনি। তবে কোয়ার্টার ফাইনালের গণ্ডি সেবার পেরোতে পারেনি আর্জেন্টিনা। জার্মানির কাছে ৪-০ গোলে পরাজিত হওয়ার পর বিশ্বকাপে পঞ্চম স্থান লাভ করে লাতিন আমেরিকার দেশটি। বিশ্বকাপের পরপরই আর্জেন্টাইন ফুটবল ফেডারেশনের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় সেই দায়িত্ব ছেড়ে দেন তিনি।
ফুটবল থেকে বিদায় নেওয়ার পর গত আড়াই যুগেও বারবারই সংবাদ শিরোনাম হয়েছেন ম্যারাডোনা। কখনো নতুন বান্ধবী জুটিয়ে, কখনো মাদক নেওয়ার অভিযোগে, কখনো সাংবাদিকদের সঙ্গে মারমুখী আচরণের কারণে বারবার আলোচনায় ফিরে এসেছেন তিনি। নিজে আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে অবসর নেওয়ার পরও প্রতিটি বিশ্বকাপেই আর্জেন্টিনার ম্যাচগুলোতে বরাবরই ক্যামেরা গ্যালারিতে খুঁজে ফিরেছে তারই মুখ। ফুটবল ভক্তরাও গ্যালারিতে উচ্ছ্বল ম্যারাডোনাকে একনজর দেখার জন্য যেন মুখিয়ে থাকত।