নিজস্ব প্রতিবেদক:
বাংলাদেশ-মিয়ানমার আন্তর্জাতিক সীমান্তে মাছ ধরার ট্রলারে করে মিয়ানমারের সেনাদের সন্দেহজনক গতিবিধি লক্ষ্য করেছে বাংলাদেশ। সীমান্ত এলাকায় অন্তত তিনটি পয়েন্টে গত কয়েকদিনে দেশটির সৈন্যদের উপস্থিতি দেখা গেছে। বিনা উস্কানিতে এভাবে সীমান্তের কাছে নতুন করে সেনা সমাবেশের প্রতিবাদে ঢাকায় মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত অং কিউ মোয়েকে রোববার (১৩ সেপ্টেম্বর) তলব করা হয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে।
রাখাইনে সৈন্য সমাবেশ নিয়ে কড়া প্রতিবাদ ও উদ্বেগ প্রকাশের পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের বিষয়ে উদ্যোগ নিতেও রাষ্ট্রদূতকে বলা হয়েছে বলে জানান মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।সন্দেহজনক এসব তৎপরতা বন্ধ করে দুই দেশের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি অবসানে মিয়ানমারকে দ্রুত পদক্ষেপও নিতে বলেছে বাংলাদেশ।
শুক্রবার (১১ সেপ্টেম্বর) ভোরে কা নিউন ছুয়াং, মিন গা লার গি ও গার খু ইয়া—দুই দেশের আন্তর্জাতিক সীমান্তের এ তিন পয়েন্টে ট্রলার থেকে সৈন্যরা নেমেছেন। এর সীমান্ত পয়েন্টগুলোর মধ্যে অন্তত একটির দূরত্ব আন্তর্জাতিক সীমান্তের ২০০ মিটারের মধ্যে। ওই তিন পয়েন্টে মাছ ধরার ট্রলারের কাঠের নিচে বসিয়ে সৈন্যদের জড়ো করা হয়েছে। ওইদিন একদিনেই অন্তত এক হাজারের বেশি মিয়ানমারের সৈন্যদের আনা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
মন্ত্রণালয়ের মিয়ানমার উইংয়ের মহাপরিচালক দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমরা রাষ্ট্রদূতকে ডেকেছিলাম এবং আমাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছি। বলেছি, তিনি যেন যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে আমাদের বার্তা পৌঁছে দেন।’
বাংলাদেশ-মিয়ানমার আন্তর্জাতিক সীমান্তে শুক্রবার ভোর থেকে মাছ ধরার ট্রলারে করে মিয়ানমারের সেনাদের সন্দেহজনক গতিবিধির খবর দেয় বিভিন্ন গণমাধ্যম। সীমান্ত এলাকার ওই তিন পয়েন্টে গত কয়েকদিনে মিয়ানমারের সৈন্যদের উপস্থিতি দেখার কথা জানিয়েছেন স্থানীয়রাও।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা ধারণা করছেন, রাখাইনের আরাকান আর্মির সঙ্গে যে সংঘাত চলমান, তার অংশ হিসাবে সৈন্যদের আসা-যাওয়া হতে পারে।
সেখানে এমন সন্দেহজনক গতিবিধি ঘটলে বাংলাদেশের উদ্বেগের কারণ রয়েছে। তিন বছর আগে রাখাইনে সেনা অভিযানের পর দমন-পীড়নের মুখে লাখ লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে আসে বাংলাদেশে।
মিয়ানমার ও ঢাকার সম্পর্কের বিষয়ে যুক্ত সূত্রগুলো জানিয়েছে, সন্দেহজনক গতিবিধির মাধ্যমে এ সেনা সমাবেশ দুই দেশের মধ্যে ভুল–বোঝাবুঝি সৃষ্টির সুযোগ তৈরি করতে পারে। পাশাপাশি ২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইনে গণহত্যা শুরুর প্রাথমিক পর্বে এভাবেই সেখানে সৈন্যদের জড়ো করেছিল মিয়ানমার সেনাবাহিনী। ফলে ১১ সেপ্টেম্বর ভোরে শুরু হওয়া সেনা সমাবেশের কারণে রাখাইনে এখন যেসব রোহিঙ্গা রয়েছেন, তাদের মধ্যে নতুন করে ভীতি ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘রাখাইনে সংঘাতপূর্ণ এলাকায় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীও রয়েছে। সে কারণে আমাদের জন্য তা বেশ উদ্বেগের। আবার যদি কোনো কারণে রোহিঙ্গা ঢল নামে আমাদের চাপের ওপর চাপ বাড়বে।’
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইনে সেনা অভিযান শুরুর পর কয়েক মাসের মধ্যে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেন। আগে থেকে বাংলাদেশে ছিল আরও চার লাখ রোহিঙ্গা।
আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে মিয়ানমারের সরকার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে ২০১৭ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করলেও সেই প্রত্যাবাসন আজও শুরু হয়নি।
গত বছর দু’দফায় প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও রাখাইন রাজ্যের পরিবেশ নিয়ে শঙ্কার কথা তুলে ধরে ফিরতে রাজি হননি রোহিঙ্গারা।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, মিয়ানমারের সেনাদের বাংলাদেশ সীমান্তে মোতায়েনের আরও একাধিক কারণ থাকতে পারে। একটা কারণ হতে পারে, সেনা সমাবেশ বাড়িয়ে নিজেদের উপস্থিতি আরও জোরদার করা। আরেকটা কারণ হতে পারে, তিন–চার বছর ধরে, বিশেষ করে যারা ২০১৭ সালের আগস্টের রোহিঙ্গা গণহত্যার অপারেশনে যুক্ত ছিলেন, তাদের দ্রুত সীমান্ত থেকে সরিয়ে নেওয়া। বিশেষ করে আইসিসিতে দুই সৈন্যের জবানবন্দি রেকর্ডের পর থেকে পুরোনো সেনাদের মিয়ানমার সরকার সীমান্ত থেকে ফেরত নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। নতুন করে আর কোনো সৈন্য যেন পক্ষ ত্যাগ করতে না পারে, সে বিষয়ে মিয়ানমার জোর দিচ্ছে।
বাংলাদেশ ও রাখাইনে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের অভিযোগ, এখনো রাখাইনে আবদ্ধ জীবন কাটছে রোহিঙ্গাদের। আরাকান আর্মির সঙ্গে মিয়ানমার সেনাদের সংঘাত সেখানে যোগ করেছে নতুন মাত্রা। মিয়ানমার সেনাদের হাত থেকে এখন রেহাই পাচ্ছে না সেখানে অবস্থানরত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরাও। গত মার্চ থেকে রাখাইনে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের অন্তত ১০টি গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ইদানিং রাখাইনের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকজনও বুঝতে পারছেন, রোহিঙ্গারা চলে গেলে তাঁরা ভালো থাকবেন, সেটা দুরাশা ছাড়া কিছুই নয়।
রাখাইনে সৈন্য সমাবেশ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশের পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়ার বিষয়টিও রাষ্ট্রদূতকে বলা হয়েছে বলে জানান মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।