নিজস্ব প্রতিবেদক:
দুই বছরের সাজাপ্রাপ্ত আসামি পলাতক লিটনের পরিবর্তে সাজাভোগ করেছেন নিরাপরাধ লিটন! এ বিষয়ে হাইকোর্ট লিটনের কারাবন্দি থাকার ঘটনা তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন।
ঢাকার ২ নম্বর বিশেষ জজ আদালতের বিচারককে ২ সপ্তাহের মধ্যে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় আদেশ দিতে বলা হয়েছে।
মঙ্গলবার (০১ সেপ্টেম্বর) বিচারপতি তারিক উল হাকিম ও বিচারপতি এস এম কুদ্দুস জামানের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
কেবলমাত্র নামের মিল থাকায় বিনাদোষে নয়মাস ধরে কারাগারে থাকা মো. লিটন পেশায় দিনমজুর। ভোলার লালমোহন উপজেলার ধলীগৌরনগর ইউনিয়নের চতলা গ্রামে তার বাড়ি।
গত বছরের ৭ ডিসেম্বর মেঘনাপাড়ে ব্লকের কাজ সেরে বাড়ি ফিরছিলেন লিটন। এ সময় মঙ্গল সিকদার পুলিশ তদন্তকেন্দ্রের এসআই জসিম উদ্দিন সঙ্গীয় ফোর্স নিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যান। কেন গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তা না জানলেও লিটনকে আদালতে সোপর্দ করা হয়। পরে সেখান থেকে তাকে কেরাণীগঞ্জ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়।
মুক্তির আরজিতে কারাবন্দি লিটন এবং মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) করা রিট আবেদনের ওপর শুনানি শেষে এ আদেশ দেন আদালত। রিট আবেদনকারীর পক্ষে আইনজীবী ছিলেন অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না, ইয়াদিয়া জামান ও মো. শাহিনুজ্জামান। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অমিত দাসগুপ্ত।
রাজধানীর পল্টন থানার একটি মামলায় দুই বছরের দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হিসেবে ভোলার লালমোহন উপজেলার ধলীগৌরনগর ইউনিয়নের চতলা গ্রামের মৃত নুর ইসলামের ছেলে লিটনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, মূল আসামির পরিবর্তে নিরাপরাধ ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ নিয়ে ‘শুধু নাম-ঠিকানা মিলে জেল খাটছেন দিনমজুর’ শিরোনামে গত ২২ আগস্ট একটি জাতীয় দৈনিকে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এই প্রতিবেদন যুক্ত করে নিরাপরাধ লিটনের মুক্তি চেয়ে গত ২৪ আগস্ট রিট আবেদন করা হয়। আবেদনে লিটনের পরিচয় নিশ্চিত করতে তাকে সশরীরে অথবা ভার্চুয়ালি হাইকোর্টে হাজির করা, তাৎক্ষণিক মুক্তি দেওয়া এবং তার আটকাদেশ অবৈধ ঘোষণার নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে।
পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে, সাজাপ্রাপ্ত আসামি আর কারাবন্দি লিটনের বাবার নাম, গ্রাম-সবই এক। তবে দাদার নাম ও বয়স ভিন্ন। মামলার নথি অনুসারে সাজাপ্রাপ্ত লিটনের বর্তমান বয়স ৪১ বছর। আর কারাবন্দি লিটনের বয়স এখন ৩০ বছর। এ ছাড়া সাজাপ্রাপ্ত লিটনের বাবা মারা গেছেন ৩০ বছর আগে। আর বন্দি লিটনের বাবা মারা গেছেন ১০ বছর আগে।
অ্যাডভোকেট ইয়াদিয়া জামান জানান, সাজাপ্রাপ্ত লিটনের দাদার নাম আবুল হক। আর কারাবন্দি লিটনের দাদার নাম হাবি দরবেশ।
ভারত ও পাকিস্তানের তৈরি আমদানি নিষিদ্ধ চেতনানাশক ট্যাবলেটসহ লিটন, শামীম ও আরশাদ মিয়াকে ২০০৯ সালের ২৮ জুন পল্টন থানার আহাদ পুলিশ বক্সের সামনে থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এ ঘটনায় পল্টন থানায় মামলা হয়। পরে তারা আদালত থেকে জামিন নিয়ে আত্মগোপন করেন। এই মামলায় বিচার শেষে ২০১৪ সালের ২২ অক্টোবর ঢাকা মহানগর বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-২ আসামিদের দুই বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড দেন।
এই রায়ের পর গত বছরের ৭ ডিসেম্বর লিটনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। লিটনের ভাই সাইফুল ইসলামের দাবি, তার ভাইয়ের বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেই। তিনি নিরাপরাধ। দিনমজুরের কাজ করে সংসার চালান।
ভাইকে মুক্ত করতে ঢাকায় আদালত আর আইনজীবীর পেছনে ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন সাইফুল। রিকশা চালিয়ে দিনযাপন করা সাইফুলের নিজের আর্থিক অবস্থাও ভালো না। যে কারণে উকিলের খরচ চালাতেও অপারগ তিনি।
এতে বিনাদোষে জেল খাটতে হচ্ছে তার নিরাপরাধ ভাই লিটনকে। তিনি জানান, মো. লিটন নামে চতলা গ্রামের আরেক যুবক আছেন। যিনি শৈশব থেকে ঢাকায় থাকেন, বাড়িতেও আসেন না। তার বাবার নামও মৃত নুরুল ইসলাম। চতলা হাইস্কুলের পেছনে ওই লিটনের বাড়ি। রাজধানীর বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত তিনি। সেই লিটন সাজাপ্রাপ্ত আসামি হলেও কেবল নামের মিলে তার সাজা ভোগ করছেন সাইফুলের ভাই লিটন। ২০০৯ সালে পল্টন থানায় যখন মামলা হয়, এই দিনমজুর লিটন তখন ঢাকায়ও ছিলেন না।
লিটনের প্রতিবেশী সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মাসুদ করিম নীরব ও সাবেক ইউপি সদস্য আবু সুফিয়ান জসিমও বলেন, যে লিটন এখন জেল খাটছেন, তিনি দিনমজুর, এলাকাতেই থাকেন। একই এলাকায় আরেক লিটন আছেন, যার বাবার নামও নুরুল ইসলাম। তিনি ছোটবেলা থেকেই ঢাকা থাকেন, এলাকায় আসেন না। ঢাকায় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করে লালমোহনের ঠিকানা ব্যবহার করেন। সেই লিটনের বদলে পুলিশ দিনমজুর লিটনকে গ্রেপ্তার করেছে। যিনি আজ নয়মাস ধরে বিনাদোষে জেল খাটছেন। লিটনের স্ত্রী ও দুই সন্তান আছে। তারা অসহায়ভাবে দিনযাপন করছেন।’
সাজাপ্রাপ্ত ঢাকার লিটনের চাচা ফারুক চতলা এলাকায় অটোরিকশা চালান। তিনি জানান, তার ভাই নুরুল ইসলাম প্রায় ৩০ বছর আগে মারা গেছেন। লিটন নামে তার এক ভাতিজা আছে, যে ঢাকায় থাকে। বহু বছর আগে ঢাকায় তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। এর পর আর যোগাযোগ নেই।
ফারুকের ছেলে জুয়েল চতলা বাজারে কম্পিউটারের দোকানে কাজ করেন। তিনি জানান, লিটন তার চাচাতো ভাই। ঢাকায় থাকেন। তার সঙ্গে পরিবারের কারও যোগাযোগ নেই।
সান নিউজ/ আরএইচ/ এআর