নিজস্ব প্রতিবেদক:
দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে দেশের সবচেয়ে ব্যয়বহুল রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ। এরই মধ্যে শেষ হয়েছে প্রকল্পের সাড়ে ১৮ শতাংশ কাজ। প্রায় ১ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকার এ প্রকল্পে এখন পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ২১ হাজার কোটি টাকা। বর্তমান সরকারের ১০ মেগা প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ একটি হল পাবনার ঈশ্বরদীর এই রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র।
সবকিছু ঠিকমতো চললে ২০২৫ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হবে এ প্রকল্পের কাজ। আর প্রকল্প পুরোপুরি বাস্তবায়িত হলে বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুই ইউনিটের প্রতিটি থেকে ১২০০ করে মোট ২৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হবে।
রাশিয়ার সহযোগিতায় নির্মিতব্য কেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট উৎপাদনে যাবে ২০২৩ সালে এবং দ্বিতীয় ইউনিট ২০২৪ সালে।
রূপপুর নির্মাণকাজের দায়িত্বে থাকা রাশিয়ার রোসাটমের প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন, বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির গুরুত্বপূর্ণ অংশ রিয়্যাক্টর বিল্ডিংয়ের প্রথম ধাপের ইন্টারনাল কনটেইনমেন্ট স্থাপনার কংক্রিট নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে। একে প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অর্জন মন্তব্য করে তারা জানান, রাশিয়ায় কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে এ প্রকল্পের যন্ত্রপাতি নির্মাণের কাজ চলছে। এরই মধ্যে ভারি এ যন্ত্রপাতির অনেকগুলোই প্রকল্প এলাকায় পৌঁছেছে।
চলতি বছরের শুরুতেই প্রকল্পটির ইউনিট ১-এর জন্য যন্ত্রপাতি স্থাপনের কাজ শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। প্রকল্প পরিচালক ড. মো. শৌকত আকবর সান নিউজকে বলেন, ‘পদ্মা সেতুর মতো রূপপুর বিদ্যুৎ প্রকল্পও ক্রমেই দৃশ্যমান হচ্ছে। এ ধরনের কাজ শুরু হলে নির্মাণকাজে কোনো বিরতি দেওয়া হয় না, টানা ২৪ ঘণ্টাই কাজ চলে।’
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৬০ বছর নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। এর পেছনে বার্ষিক খরচ হবে এক হাজার কোটি টাকা।
বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন শুরু হলে পারমাণবিক বিদ্যুৎ জগতে প্রবেশ করবে বাংলাদেশ। বর্তমানে পৃথিবীর ৩০টি দেশে ৪৪৯টি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে। সেগুলো থেকে উৎপাদন হচ্ছে বিশ্বে উৎপাদিত মোট বিদ্যুতের প্রায় ১২ শতাংশ।
১৪টি দেশে আরও ৬৫টি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণাধীন রয়েছে। ২০২৫ সালের নাগাদ আরও ২৭টি দেশে ১৭৩টি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের প্রক্রিয়া চলছে। এগুলোর মধ্যে ৩০টি পরমাণু বিশ্বে নবাগত দেশ, যার মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে।
২০২৩ সালে প্রথম ইউনিট চালু হলে বিদ্যুৎ কেন্দ্রে প্রয়োজন হবে প্রায় ২ হাজার ৭০০ কর্মী। রাশিয়া থেকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের দক্ষ করে গড়ে তোলা হবে। এরই মধ্যে ৩ শতাধিক নিউক্লিয়ার প্রকৌশলীর প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন রাশিয়ায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে থাকবে বিদেশি বিশেষজ্ঞরাও।
সরকারের সবচে ব্যয়বহুল এ প্রকল্পে এরই মধ্যে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। এ প্রকল্পে কর্মকর্তাদের জন্য আসবাবসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজে অস্বাভাবিক ব্যয় দেখানো হয়। পরবর্তীতে গণমাধ্যমে তা নিয়ে লেখালেখি শুরু হলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা হয়। তিন মামলায় পাবনা গণপূর্ত বিভাগের সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী মাসুদুল আলমসহ ১৩ প্রকৌশলী ও ঠিকাদার কারাগারে আছেন।
এসব বিতর্ক পেছনে ফেলে দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজ।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ইতিহাস বেশ পুরনো। এই মেগা প্রকল্পটি বাস্তবায়নে প্রথ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় ১৯৬১ সালে। ১৯৬২ থেকে ১৯৬৮ সালে পাবনা জেলার ঈশ্বরদীর পদ্মা নদী তীরবর্তী রূপপুরকে দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের স্থান হিশেবে নির্বাচন করা হয়। তখন প্রকল্পের জন্য ২৬০ একর এবং আবাসিক এলাকার জন্য ৩২ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। ভূমি উন্নয়ন, অফিস, রেস্ট হাউজ, বৈদ্যুতিক সাব-স্টেশন ও কিছু আবাসিক ইউনিটের নির্মাণ কাজও আংশিক সম্পন্ন করা হয়।
কিন্তু ১৯৬৯ সালে এ প্রকল্প বাতিল করে দেয় তৎকালীন পাকিস্তান সরকার । দেশ স্বাধীন হলে আবারো উদ্যোগ গ্রহণ করেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান । এরপর অন্যান্য সরকারের সময়ও এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিষয়ে বিভিন্ন সময় উদ্যোগ নেয়া হলেও বিভিন্ন জটিলতা আর সীমাবদ্ধতায় আটকে থাকে সব আয়োজন।
২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করা হয়। ২০০৯ সালে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে অপরিহার্য কার্যাবলী সম্পাদন’ শীর্ষক উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে প্রাথমিক কার্যাবলী ও পারমাণবিক অবকাঠামো উন্নয়নের কার্যক্রম শুরু হয়।
অবশেষে বাংলাদেশ সরকার এবং রুশ ফেডারেশন সরকারের মধ্যে ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তি স্বাক্ষর হয় ২০১০ সালে। ২০১১ সালে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন সংক্রান্ত আন্তঃরাষ্ট্রীয় সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর হয় বাংলাদেশ এবং রাশান ফেডারেশন সরকারের মধ্যে। । আর ৩০ নভেম্বর ২০১৭ বাংলাদেশের একক বৃহত্তম প্রকল্পটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।