নিজস্ব প্রতিবেদক:
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের সাথে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান সম্পূর্ণভাবে জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ হত্যাকাণ্ডে জিয়াউর রহমানের সম্পৃক্ততার সপক্ষে বিভিন্ন প্রমাণও তুলে ধরেন তিনি।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৫তম শাহাদাতবার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় তিনি এ অভিযোগ করেন।
রোববার (১৬ আগস্ট) তার সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সে ২৩ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এই আলোচনা সভায় যুক্ত হন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অনুষ্ঠানের শুরুতেই ১৫ আগস্টের নিহতদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডে সেদিন কর্নেল ফারুক, কর্নেল রশিদ, মেজর হুদা, মেজর ডালিম, মেজর শাহরিয়ার, মেজর পাশা, সামরিক অফিসার এরা সবাই মাজেদ, মহিউদ্দিন, মোসলে উদ্দিন, রাশেদ, খায়রুজ্জামানসহ সবাই জড়িত ছিল। কিন্তু এই সামরিক অফিসারদের কারা এবং কে মদত দিয়েছিল, তাদের পেছনে কারা ছিল? আব্বার (বঙ্গবন্ধু) কেবিনেটের একজন মন্ত্রী, তার উচ্চাভিলাষী সহযোগী জিয়াউর রহমান। যিনি একজন মেজর ছিলেন, জাতির পিতা তাকে প্রমোশন দিয়ে মেজর জেনারেল বানিয়েছিলেন। সে এর সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে জড়িত ছিল। সেটা স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়, যখন এই হত্যাকাণ্ডের পর বিবিসিতে কর্নেল ফারুক ও কর্নেল রশিদ একটি ইন্টারভিউ দেয়। সেখানে তারা স্পষ্ট বলে যে তাদের সঙ্গে জিয়াউর রহমান সম্পূর্ণভাবে জড়িত ছিল। তার মদতেই তারা এই ঘটনা ঘটাতে সক্ষম হয়েছিল। সেটা আরও প্রমাণ হয় বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর, রাষ্ট্রপতিকে হত্যার পর, সেখানে সংবিধান মানা হয়নি, ভাইস প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম কিন্তু সেখানে রাষ্ট্রপতি হননি, রাষ্ট্রপতি ঘোষিত হলো খন্দকার মোশতাক। আর খন্দকার মোশতাক রাষ্ট্রপতি হয়েই জেনারেল জিয়াকে বানালো সেনাবাহিনীর প্রধান। জেনারেল জিয়া যদি এই ষড়যন্ত্রে মোশতাকের সঙ্গে সম্পৃক্ত না থাকবে, তাহলে কেন মোশতাক তাকেই বেছে নেবে সেনাপ্রধান হিসেবে। তারপর খুনিদের সব ধরনের মদত দেওয়া, এটা তো জিয়াউর রহমানই দিয়েছে এবং এখানেই তাদের শেষ না।’
বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, ‘মোশতাক, বেইমানরা কখনও ক্ষমতায় থাকতে পারে না। মীর জাফর পারেনি। মীর জাফরকে যারা ব্যবহার করেছে সিরাজউদ্দৌলাকে হত্যা করতে, তারা মীর জাফরকে দুই মাসের বেশি ক্ষমতায় থাকতে দেয়নি। ঠিক মোশতাকও পারেনি। মোশতাককে হটিয়ে জিয়াউর রহমান নিজেকে নিজেই ঘোষণা দিয়েছিল রাষ্ট্রপতি হিসেবে। এই খুনিরা যারা শুধু ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডই ঘটায়নি; ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে যারা হত্যাকাণ্ড ঘটায়, তাদের বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া, তাদের রাজনৈতিক আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা, বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে জিয়াউর রহমান খুনিদের পুরস্কৃত করে। শুধু তা-ই নয়, খুনিদের যাতে বিচার না হয়, সেজন্য ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারি করা হয়। তাদের বিচারের পথ বন্ধ করা হয়। তাদের বিচার করা যাবে না। আমরা যারা আপনজন হারিয়েছি আমাদের মামলা করার অধিকার ছিল না, বিচার করারও অধিকার ছিল না।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘৭৫-এর পর আমি আর রেহানা (শেখ রেহানা) বিদেশে ছিলাম। ঘাতকের নির্মম বুলেটে যারা আপনজন হারিয়েছিল, অনেকে দেশে থাকতে পারেনি। এই হত্যার পর ওই পরশ ও তাপসকে খুঁজে বেড়ানো হয়েছে। কারা কারা বেঁচে আছে, তাদের খুঁজে বেড়ানো হয়েছে। সবাই গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল ভারতের মাটিতে। রিফিউজি হিসেবে আমাদের থাকতে হয়েছিল। এমনকি আমরা আমাদের নিজেদের নামটাও ব্যবহার করতে পারিনি। একদিকে আপনজন সব হারিয়েছি। একদিনের মধ্যে সব শেষ। তারপর রিফিউজি হিসেবে আমাদের থাকতে হয়েছে। আমরা যখন রিফিউজি হিসেবে থেকেছি বিদেশের মাটিতে অবস্থান করে, আর ঘাতকের দল তখন বিভিন্ন দূতাবাসে রাষ্ট্রদূতের চাকরি পেয়ে আরাম আয়েশে জীবনযাপন করে, তা আমাদের দেখতে হয়েছে। অথচ এই দেশ স্বাধীন করে গেছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।’
তিনি বলেন, ‘১৯৮০ সালে আমি লন্ডনে যাই। রেহানা তার আগেই লন্ডনে গিয়েছিল। ৮০ সালের ১৬ আগস্ট আমরা লন্ডনে এই হত্যার প্রতিবাদে সভা করি। তখন সেখানে স্যার টমাস ইউলিয়াম কিউসি এমপি এবং নোবেল লরিয়েট শন ম্যাক ব্রাইট— তাদের নিয়ে একটা আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়। সেদিনই সেই তদন্ত কমিশনের ঘোষণা দেওয়া হয়। আমাদের প্রবাসী বাংলাদেশিদের সহযোগিতায় সেই তদন্ত কমিশনের প্রতিনিধি হিসেবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ও রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার তদন্তের জন্য পাঠানো হয়। ব্রিটিশ এমপি অনেকে তখন আমাদের সহযোগিতা করেন। তিনি যখন ভিসা চান, জিয়াউর রহমান তখন রাষ্ট্রপতি। জিয়াউর রহমান কিন্তু টমাস উইলিয়ামকে ভিসা দেয়নি। জিয়াউর রহমান কেন ভিসা দিলো না। কেন তদন্ত করতে দিলো না, এই প্রশ্নটা থেকে যায়। কারণ, খুনের সঙ্গে জড়িত ছিল বলে সে ভয়ে ভীত ছিল।’ সে তদন্ত করতে দেয়নি মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘তারা খুনিদের লালন-পালন করে গেছে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘১৯৮১ সালে দেশে ফেরার পর ৩২ নম্বরের বাড়িতে আমাকে ঢুকতে দেয়নি। ৩২ নম্বরের রাস্তায় বসে আমরা মোনাজাত করি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। শোক দিবস পালন করা যাবে না, তার কথা বলা যাবে না। ইতিহাসকে সম্পূর্ণ বিকৃত করা হয়। স্বাধীনতাবিরোধীদের, রাজাকার, আল বদরদের জিয়াউর রহমান মন্ত্রী বানিয়েছে, রাজনীতি করার সুযোগ দিয়েছে, তাদের ভোটের অধিকার, এসব লোকদের নির্বাচন করার অধিকার ছিল না। ভোট দেওয়ার অধিকার ছিল না। সংবিধানের ১২ ও ৩৮ অনুচ্ছেদ বাতিল করে তাদের সংগঠন করা, নির্বাচন করার অধিকার দিয়েছে। লাখো শহীদের রক্তে রঞ্জিত আমাদের স্বাধীনতাকে ধূলিসাৎ করে বাংলাদেশকে ভিন্ন পথে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। বাংলাদেশের ইতিহাসকে সম্পূর্ণ বিকৃত করা হয়েছিল। কোথাও জাতির পিতার নাম থাকলে সেটা মুছে ফেলা হতো।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জিয়াউর রহমান মুক্তিযোদ্ধা ছিল, কিন্তু তার সঙ্গে পাকিস্তানিদের সংযোগ ছিল। কেননা, পাকিস্তানি কর্নেল বেগ জিয়াউর রহমানকে চিঠি দিয়েছিল। চিঠিতে সে বাহবা দিচ্ছে। ধন্যবাদ দিচ্ছে। জিয়াউর রহমানের স্ত্রী ও তার পুত্ররা যে ভালো আছে, সে কথাও জানাচ্ছে। নতুন কাজ দেওয়ার অঙ্গীকার করছে ওই চিঠিতে। সে কাজটা কী ছিল? তাহলে সে কাজটা কী এই ছিল— যে স্বাধীনতার সব চেতনাকে নসাৎ করবে। আর এভাবে এ দেশের মানুষ যে বিজয় অর্জন করে, সেই বিজয়কে নসাৎ করবে। আর এ দেশের স্বাধীনতাকে ভূলুণ্ঠিত করবে। এটাই কি তাদের কাজ ছিল। এই কাজটিই কি তারা পেয়েছিল, যার জন্য এই ১৫ আগস্টের মতো ঘটনা ঘটে।’
সান নিউজ/ আরএইচ