রাকিব হাসনাত, পাবনা: দেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বলেছেন, আমি ভেসে আসিনি একেবারে রাজপথ থেকেই বঙ্গভবনে গিয়েছি। পাবনার রাজপথ থেকে বঙ্গভবনে গিয়েছি। আমি বঙ্গবন্ধুর ছোয়া পেয়েছি। কারাগারে যেতে হয়েছে। চরম অত্যাচারিত হয়েছি। রাতের আধারে তুলে নেয়া হয়েছে। হাতকরা পড়ানো হয়েছে। দান্ডাবেড়ি পড়ানো হয়েছে। রাজপথের সক্রিয় হয়ে আমি বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টি আকর্ষন করে বাকশালের পাবনার জয়েন্ট সেক্রেটারি হয়েছিলাম।
মঙ্গলবার (১৬ মে) বিকেলে পাবনা সরকারি এডওয়ার্ড কলেজে মাঠে অনুষ্ঠিত নাগরিক কমিটির সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন রাষ্ট্রপতি।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গত ১৪ বছরের নানা অগ্রগতি ও পুর্বের অবস্থা মুল্যায়ন করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর যারা ক্ষমতায় এসেছে তারা মুক্তিযুদ্ধের অসম্প্রদায়িক চেতনা ধ্বংস করা করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অসাম্প্রদায়িক চেতনা আবার ফিরে এসেছে।
তিনি বলেন, পদ্মা সেতু নিয়ে সরকারকে রাজনৈতিকভাবে পরাস্ত করার ষড়যন্ত্র হয়েছিল। অনেক মন্ত্রী আমার কাছে এসে বিশ্বব্যাংকের দাবি মেনে নিতে বলেছিলেন। কিন্তু আমি রাজি হয়নি। এটা দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ছিল। স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ছিল। কিন্তু আমি শক্ত হাতে মোকাবেলা করেছি।
এসময় তিনি পাবনা থেকে সরাসরি ট্রেন চলাচলের ঘোষণা দেন। সঙ্গে সঙ্গে অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবাই আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠেন। ধাপে ধাপে পাবনাবাসীর দাবি পূরণে আশ্বাস দেন রাষ্ট্রপতি।
মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, আমার আগমন ঘিরে পাবনায় যে এইভাবে আয়োজন হবে তা কল্পনাও করিনি। পাবনাবাসীর এই উচ্ছাসের ঋণ আমি কিভাবে শোধ করবো? আমি চির কৃতজ্ঞ হয়ে থাকো। এই আয়োজন আমি জীবনেও ভুলবো না। পাবনা এ্যাডওয়ার্ড কলেজের স্মৃতিবিজড়িত এই ঐতিহাসিক মাঠে আয়োজিত নাগরিক সংবর্ধনা সভায় উপস্থিত হতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছি। আপনাদের এত ভালোভাসা ও সম্মান পেয়ো আমি আবেগাপ্লুত আনন্দিত। ঢাকার বাহিরে প্রথম সফরেই নিজ জন্মস্থান পাবনায় আসতে পেরে আমি অত্যন্ত আনন্দিত।
তিনি বলেন, স্বাধীনতা বাঙালি জাতির সবচেয়ে বড়ো অর্জন। এ অর্থতার পেছনে রয়েছে অনেক সংগ্রামের ইতিহাস যার নেতৃত্বে ছিলেন জাতির পিতা জাতি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের পিতার নেতৃত্বে একটি দিয়েছিলাম। ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ এই পাবনার টাউন হল ম্যাগানে আমরা বাংলাদেশের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে আমি যোগ দেই মুক্তি
হয়ে সরাসরি যুদ্ধে অংশ নে জাতি, আমরা মৃত্যুভয়কে উপেক্ষা করেই যুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছি। তখন যুদ্ধের পর অবশেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর অর্জন কর। রক্তমাত। ত্রিশ লক্ষ মানুষ আর দুই লক্ষ মা-বোনের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা অর্জন করে স্বাধীনতা, পেয়েছি একটি স্বাধী সার্বভৌম দেশ, একটি লাল-সবুজ পতাকা।
রাষ্ট্রপতি বলেন, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হয়েছিল বলেই আজ আমি রাষ্ট্রপতি হয়েছি। আপনারা কেউ চাকুরী করছেন। সবাই স্বাধীনভাবে নিজ নিজ পেশা বেছে নিতে পারছেন, নিজ নিজ ক্ষেত্রে কাজ করে যাচ্ছেন। তাই আমাদের সবার দায়িত্ব হবে বঙ্গবন্ধু যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে সারাজীবন জেল জুলুম ও অমানবিক অত্যাচার-নির্ধারণ সহ্য করে দেশ স্বাধীন করেছিলেন তা পুরণে নিরলস প্রয়াস চালানো। বঙ্গবন্ধু একটি ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দেশ গঠনের কাজও শুরু করেছিলেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করে দেশের অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে দিতে চেয়েছিল।
৭১'র স্মৃতিচারণ করে বলেন, জাতির পিতার নির্মম হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে আমি এই পাবনা শহরে প্রতিরোধ মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছিলাম। ১৯৭৫ সালের ২০ আগস্ট আমাকে গ্রেফতার করে সেনা ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। সেনাক্যাম্পে আমিসহ আরও অনেককে নিয়ে আসা হয়েছি সেখানে টানা তিন মাস চলে অসহ্য-অমানবিক নির্যাতন। তারপর তিন বছর কারাভোগের পর ১৯৭৮ সালে আমি কারাগার থেকে মুক্তি পাই। তারপর আমি বিচারক হিসেবে সরকারি চাকুরীতে যোগ দেই। এসময় আমি সাধ্যমত দেশের জন্য কাজ করেছি। আমি জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে চাকুরী থেকে অবসর নিয়েছি। পরবর্তীতে দুর্নীতি দমন কমিশনের কমিশনার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছি। দুর্নীতি দমন কমিশনে দায়িত্ব পালনকালে বিশ্বব্যাংক কর্তৃক পদ্মা সেতু প্রকল্পে যে দুর্নীতির অভিযোগ করা তদন্তের দায়িত্বভার আমাকে দেওয়া হয়েছিল। এটা ছিলো এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। আমার দেওয়া প্রতিবেদনের ভিত্তিতে কানাডার আদালতে বিশ্বব্যাংকের সেই অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয়। এই চাপ মোকাবিলায় আমার প্রতি পাবনাবাসীসহ দেশবাসীর দোয়া ছিলো বলেই এই কঠিন কাজ আমি সফলভাবে শেষ করতে পেরেছি।
মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, দেশের রাষ্ট্রপতি হবো এটা কখনো ভাবিনি। কিন্তু ভাগ্য আজ আমাকে রাষ্ট্রপতির পদে বসিয়েছে। আপনাদের দোয়া আর ভালোবাসা ছিলো বলেই আমি এ পর্যন্ত আসতে পেরেছি। আপনাদের ভালোবাসাকে সঙ্গী করেই রাষ্ট্রপতি পদের দায়িত্ব পালন করে যেতে চাই। এজন্য আপনাদের দোয়া ও সহযোগিতা চাই। পাবনা জেলা ও দেশের উন্নয়নে আপনারা নিজ নিজ অবস্থান থেকে কার্যকর অবদান রাখবেন এটাই আমি প্রত্যাশা করি। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে শামিল হয়েছে। করোনা মহামারি ও রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দা প্রভাব থাকা স্বত্বেও প্রধানমন্ত্রীর প্রজ্ঞা ও গতিশীল নেতৃত্বে বাংলাদেশের অর্থনীতি স্থিতিশীল। মানুষের গড় আয়ু ও জীবযাত্রার মান বেড়েছে এবং বিভিন্ন উন্নয়নসূচকে বাংলাদেশ পার্শ্ববর্তী অনেক দেশ থেকে ভালো অবস্থায় অবস্থান করছে। উন্নয়নের এ ধারা অব্যাহত রাখতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করে প্রত্যেককে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে।
তিনি আরও বলেন, ১৯৭২ সালের ২৬ শে ফেব্রুয়ারি পাবনার নগরবাড়ীর জনসভায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “আমাদের রাস্তাঘাট নেই, আমাদের গ্রামগুলো জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে, আমাদের খাদ্যশস্যের গুদাম পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এক কথায়, আমাদের গোটা অর্থনীতি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এবং আজ আমরা দারুণ এক পরিস্থিতির সম্মুখীন। কিন্তু তাই বলে আমরা আমাদের স্বাধীনতাকে বিক্রি করে দিতে পারি না"। রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধুর সেই দূরদর্শী বক্তব্যের মমার্থ সবাইকে অনুধাবন করতে হবে। অনুকূল বা প্রতিকূল যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করে আমাদেরকে মাতৃভূমির স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে দেশের জন্য কাজ করতে হবে। দেশে গণতন্ত্র ও উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। একজন নাগরিক হিসাবে দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে সার্বক্ষণিক প্রয়াস চালাবেন এটাই সকলের প্রত্যাশা।
এর আগে ৩টা ২৪ মিনিটে অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত হোন রাষ্ট্রপতি। এসময় দাঁড়িয়ে হাতে তালিয়ে কৃতিসন্তানকে বরণ করেন পাবনাবাসী। পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতসহ ধর্মগ্রন্থ পাঠের মাধ্যমে মঙ্গলবার (১৬ মে) বিকেল ৩টা ২৭ মিনিটে সংবর্ধনা অনুষ্ঠান শুরু হয়। অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতির সহধর্মিণী ফাস্টলেডি রেবেকা সুলতানা উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে বীর মুক্তিযোদ্ধা বেবী ইসলামের সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন ডেপুটি স্পিকার ও পাবনা-১ আসনের সংসদ সদস্য শামসুল হক টুকু, পাবনা-৫ আসনের সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক প্রিন্স, পাবনা-৪ আসনের সংসদ সদস্য নুরুজ্জামান বিশ্বাস, পাবনা-৩ আসনের সংসদ সদস্য মকবুল হোসেন, পাবনা-২ আসনের সংসদ সদস্য আহমেদ ফিরোজ কবির, নারী সংরক্ষিত আসনে সংসদ সদস্য নাদিরা ইয়াসমিন জলি, পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রেজাউল রহিম লাল, নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক অঞ্জন চৌধুরী, সদস্য সচিব-১ অধ্যাপক শিবজিত নাগ, সদস্য সচিব-২ আব্দুল মতীন খান এবং পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. হাফিজা খাতুন।
এর আগে চার দিনের সফরের দ্বিতীয় দিনে বেলা ১১টার দিকে পাবনার বিসিক শিল্পনগরীতে স্কয়ার সায়েন্স এন্ড লাইফ প্ল্যান্ট উদ্বোধন করেন রাষ্ট্রপতি। পরে দুপুর ১২টার দিকে পাবনা প্রেসক্লাবে স্থানীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন।
সোমবার (১৫ মে) সকাল ১২টা ৮ মিনিটে ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারযোগে নিজ জেলা পাবনায় এসে পৌঁছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। এরপর পাবনা সার্কিট হাউজে উপস্থিত হয়ে গার্ড অব অনার গ্রহণ করেন। সেখানে কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর দুপুর দেড়টায় জেলা পরিষদ বঙ্গবন্ধু চত্ত্বরের নাম ফলক উদ্বোধন ও বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতির পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। দুইটার দিকে পাবনা সদর আরিফপুর কবরস্থানে বাবা-মায়ের কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণ ও মোনাজাতে অংশ নেন। এরপর তিনি স্কয়ার বাগানবাড়িতে পারিবারিক সমাধিস্থলে উপস্থিতি, পুষ্প অর্পণ এবং প্রার্থনায় অংশ নিয়ে প্রথম দিনের কার্যক্রম শেষ করে সার্কিট হাউজে অবস্থান করেন।
রাষ্ট্রপতির প্রটোকল অফিসার নবিরুল ইসলাম সাক্ষরিত সফরসূচি অনু্যায়ী জানা গেছে, সফরের তৃতীয় দিন ১৭ মে বুধবার বেলা ১১ টায় পাবনা ডায়াবেটিক সমতি পরিদর্শন। বিকেল ৪ টায় জেলা ও দায়রা জজ আদালতের যাদুঘর, বঙ্গবন্ধু কর্ণার, বঙ্গবন্ধু ম্যুরাল উদ্বোধন এবং আইনজীবীদের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন। এছাড়া বিকেলে ৫ টায় বীর মুক্তিযোদ্ধা সাহাবুদ্দিন চুপ্পু বিনোদন পার্ক পরিদর্শন করবেন। ১৮ মে বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১১ টায় সার্কিট হাউজে গার্ড অব অনার গ্রহণ শেষে ১১.৪০ মিনিটে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিবেন।
পাবনার জেলা প্রশাসক বিশ্বাস রাসেল হোসেন এসব তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, মহামান্য রাষ্ট্রপতির পাবনা সফর ঘিরে প্রশাসন তৎপর রয়েছে। তার পাবনা সফর যাতে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে শেষ করতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে তৎপর রয়েছি।
সান নিউজ/এনকে