নিজস্ব প্রতিবেদক:
সারাদেশের মতোই কোনভাবেই ঠেকানো যাচ্ছে না ঢাকার চারপাশের নদীগুলো দখল। উচ্ছেদকৃত অনেক স্থানে আবারও গড়ে ওঠেছে স্থাপনা। অনেকেই অবৈধ বালু মহল তৈরি করে করছেন ব্যবসা। কেউ আবার মালামাল রেখে দখল করছে নদীর জমি। রাজাধানী ঢাকার চারপাশের বুড়িগঙ্গা, বালু, তুরাগ ও শীতলক্ষ্যা নদীর দুই পাড়ের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের পর বছর না ঘুরতেই বেদখল হচ্ছে নদীর দুই পাড়।
বুড়িগঙ্গা নদীর শ্মাশানঘাটসহ আশপাশের এলাকা ঘুরে দেখা গেছে উদ্ধারকৃত অনেক জমি আবারও বেদখল হয়েছে। স্থানীয়রা বলছেন, উদ্ধারের মাত্র এক মাসের ব্যবধানে উচ্ছেদকৃত জমি দখলে নিয়েছে ভূমিদস্যুরা। এরা প্রত্যেকেই প্রভাবশালী ব্যক্তি।
বুড়িগঙ্গা প্রথম সেতু থেকে ফতুল্লা পর্যন্ত নদীর দুপাড়ে অন্তত ২৫টি ঘাট আবারও দখল করে চলছে বালুর ব্যবসা। উচ্ছেদকৃত জায়গায় আগের মতোই ড্রেজার দিয়ে নদী থেকে চলছে বালু উত্তোলন। রাতের আঁধারে বিকি-কিনি হচ্ছে সেই বালু। ট্রাকে করে চলে যাচ্ছে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায়। এক বালু কারবারি জানান, প্রতিটি ঘাটে দৈনিক আড়াই থেকে ৩ লাখ টাকার বালু বেচা-কেনা হয়।
রাজধানী ঢাকার চারপাশের নদী দখল মুক্ত করতে গতবছর ব্যাপক উচ্ছেদ অভিযান চালায় বিআইডব্লিউটিএ। বিশেষ করে বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ নদের তীরে অভিযান চালানো হয় বেশি। গুড়িয়ে দেয়া হয় বহুতল ভবনসহ অনেক স্থাপনা।
বিআইডব্লিউটিএ হিসেবে, ২০১৯ সালের ২৯ জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত নদীগুলোর পাড় থেকে ৪ হাজার ৭৭২টি ছোটবড় অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। নদী দখল করে গড়ে তোলা হাউজিং প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকেও উদ্ধার করা হয় জমি। উচ্ছেদে করা হয় ক্ষমতাশালীদের অনেক প্রতিষ্ঠান ও আবাসিক স্থাপনাও। দখলমুক্ত হয় ঢাকার চারপাশের চারটি নদীর ১২১ একরের বেশি জায়গা।
এতোদিন বুড়িগঙ্গা, বালু, তুরাগ ও শীতলক্ষ্যা নদীর অবৈধ দখলকৃত জমির পরিমাণ অন্তত আড়াইশ একর। আবদুল্লাহপুর থেকে গাবতলী পর্যন্ত তুরাগ নদের প্রায় ১০ কিলোমিটারে মধ্যে দখল হয়েছে প্রায় ১২১ একর। কামরাঙ্গীরচর থেকে বসিলা পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার এলাকায় বুড়িগঙ্গা নদীর দখল হয়েছে প্রায় ১০০ একর। কাঁচপুর থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত শীতলক্ষ্যা নদীর ৫ কিলোমিটারের মধ্যে দখল হয়েছে প্রায় ২৫ একর। আর বালু নদীর ডেমরা থেকে নন্দীপাড়া পর্যন্ত ৬ কিলোমিটারের মধ্যে দখল হয়েছে প্রায় ১০ একর জমি।
এর মধ্যে গতবছর দখল মুক্ত হয়েছে ১২১ একক এলাকা। এখনও অবৈধ দখলদারদের হাতে রয়েছে চারটি নদীর অন্তত ১৩০ একর জমি। দখলমুক্ত এলাকা থেকে এরই মধ্যে বিভিন্ন স্থানে নতুন করে দখল করেছে ভুমিদস্যুরা। কি পরিমান জমিতে আবারও নতুন করে দখল হয়েছে তার কোন হিসেব নেই সংশ্লিষ্ট কোন কর্তৃপক্ষের কাছেই।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডিব্লিউটিএ) জানায়, বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শতিলক্ষ্যা ও বালু নদীর তীর দখল করে গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের অভিযান আবারও জোড়ালোভাবে শুরু হবে আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ থেকে।
শুধু রাজধানী নয়, সারাদেশের প্রায় সব নদীর তীরই গ্রাস করেছে দখলদাররা, যাদের প্রায় সবাই কোন না কোনভাবে প্রভাবশালী।
সারাদেশে অবৈধ নদী দখলদার রয়েছে ৪৯ হাজার ১৬২ জন । এই তথ্য উঠে এসেছে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ নদী কমিশনের বার্ষিক প্রতিবেদনে। এর বাইরেও কেউ নদী দখল করে থাকলে তাদের নাম দ্বিতীয় তালিকায় প্রকাশ করা হবে বলে জানানো হয় তখন। এরই মধ্যে দ্বিতীয় তালিকা তৈরির জন্য মাঠ পর্যায়ে তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু করেছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, আগে বাংলাদেশে নদীর সংখ্যা ছিলো ৮০০টি। বর্তমানে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ৪০৫টির। এরমধ্যে আবার বেশিরভাগ নদীই দূষণ, দখল, আর চরের কারণে মৃতপ্রায় অবস্থায় রয়েছে।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন বলছে, নদী দখল, দূষণ ও নাব্য সংকট অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। গাবতলী ব্রিজ হতে ঢাকা ময়মনসিংহ মাহাসড়কের টঙ্গি ব্রিজ পর্যন্ত তুরাগ নদ দখল চিত্র ভয়াবহ।
একই চিত্র বুড়িগঙ্গার। নদীর উভয় তীর দখল করে অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি সিমেন্ট কারখানা, বালু ব্যবসা, ডকইয়ার্ড, বহুতল ভবন, বাগানবাড়ি, অসংখ্য ইটভাটাসহ বিভিন্ন স্থাপনা। শুধু বেসরকারি নয়, অনেক স্থাপনা গড়ে উঠেছে খোদ সরকারি পর্যায়ে।
নদীগুলো দখল ও দূষণরে ফলে সমাজে বিরূপ প্রভাবের কথা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে ভূমিহীনতা, দারিদ্র, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পেশা পরিবর্তন, স্থানান্তর, খাবার, প্রয়োজনীয় পানির অভাব, জনস্বাস্থ্য ও শিক্ষার ওপর ব্যাপক প্রভাবের কথা।
দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া না হলে অচিরেই হারিয়ে যাবে অনেক নদী। হুমকির মুখে পড়বে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবন ধারা। বিপন্ন হয়ে পড়বে জীববৈচিত্র। বাংলার প্রাণ এই নদীগুলো রক্ষায় হাইকোর্টও বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নির্দেশনা দিয়েছেন। নদী রক্ষায় কার্যকর ব্যবস্থা নিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও দিয়েছেন নির্দেশ। তারপরও দখল এবংদূষণমুক্ত হচ্ছে না বাংলাদেশের প্রাণ এই নদীগুলো ? তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, তাহলে কি সরকারের চাইতে অনেক বেশি ক্ষমতাবান ভূমিদস্যুরা ? না কি এক্ষেত্রে সদিচ্ছার অভাব কিংবা বিশেষ স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় রয়েছে সরকারি সংস্থাগুলোতেই?