রাকিব হাসান :
প্রতারণা জালিয়াতি ও নানা অনিয়মের মধ্যে দিয়ে রিজেন্ট হাসপাতাল ও গ্রুপের চেয়ারম্যান সাহেদ করিম করেছে ত্রাসের সাম্রাজ্য। আর এতে তিনি পেয়েছেন প্রতারকের কিং তকমা। এ ধরনের প্রতারক কিভাবে দেশের বড় মিডিয়া গুলোয় সুযোগ পায়? এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে সবার মাঝে।
তাহলে মিডিয়ায় কি চলছে অতিথি বাণিজ্য? রয়েছে কি মিডিয়ার ভিতরেই ভূত লুকিয়ে? দেশের বড় বড় মিডিয়া কি তাহলে খুলেছে প্রতারক বানানোর কারখানা?
দেশের বড় বড় মিডিয়া ও প্রশাসনের নাকের ডগায় বসে ছিলেন প্রতারক সাহেদ করিম। তার প্রতারণার কি কোন অংশই পেত না মিডিয়া বা প্রশাসন? নাহলে এসএসসি পাশ করা সাহেদ কিভাবে দেশের মিডিয়াগুলোয় সুযোগ পেল!
শিক্ষার কথা বাদই দিলাম, তিনি কি কোন বিশেষ বিষয়েও অভিজ্ঞ ছিলেন যার কারণে তাকে মিডিয়ায় আনা হয়েছে। দেশের সাধারণ জনগনকে শোনানো হয়েছে তার কথা।
দেশের টিভি পর্দায় সাহেদ করিমকে দেখা গিয়েছে কখনও সঞ্চালকের চেয়ারে বসে অনুষ্ঠান করতে আবার বেশির ভাগ অনুষ্ঠানেই ছিলেন বিশেষ অতিথি হিসেবে।
কিন্তু একজন এসএসসি পাশ করা প্রতারক কিভাবে দেশের মিডিয়া গুলোয় বিশেষ অতিথি হিসেবে সুযোগ পায় তাও আবার কোন বিশেষ বিষয়ে অভিজ্ঞতা ছাড়া? এই বিষয়ে জনমনে দেখা দিয়েছে প্রশ্ন। শিক্ষা দিয়েই সব কিছুর মাপ করা যায় না তা ঠিক কিন্তু তিনি যে কোন বিষয়ে অভিজ্ঞ ছিলেন তাও নয়। তাহলে কি মিডিয়ার ভিতরেও রয়েছে ভূত? নাকি ভূতের বিশাল সাম্রাজ্য?
সাহেদ করিমদের মতো মানুষদের কারা মিডিয়ায় সুযোগ করে দিচ্ছে তা নিয়েও ফেসবুকে চলছে সমালোচনার ঝড়। অনেকের মতে, মিডিয়া যদি অতিথি নির্বাচন করতে না পারে এবং এর মধ্যে যদি আদৌ অতিথি বাণিজ্য চলে থাকে তাহলে একের পর এক সাহেদ তৈরি হবে এ দেশে। যা আমাদের জন্য হবে খুবই দুঃখজনক। যার দায় কখনই এড়াতে পারবে না দেশের মিডিয়াগুলো।
মিডিয়া গুলোতে যারা বিশেষ অতিথি হিসেবে আসে তাদের কোন শিক্ষাগত যোগ্যতার কি প্রয়োজন রয়েছে নাকি মিডিয়ার নীতিমালায় এ বিষয়ে কিছু উল্লেখ আছে? আর যদি না থাকে তাহলে এখন তা নিয়ে ভাবার সময় এসেছে কিনা?
সান নিউজের এমন প্রশ্নের জবাবে সাবেক প্রধান তথ্য কমিশনার এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক গোলাম রহমান বলেন, 'মিডিয়া বা টকশোতে ডাকা হয় যাদের বিশেষ বিষয়ে অভিজ্ঞতা বা যোগ্যতা রয়েছে এমন ব্যক্তিদের। তা শিক্ষাগত যোগ্যতা হতে পারে, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কারণে হতে পারে এমনকি সমাজে তার পদ ও পদবির কারণেও হতে পারে। শিক্ষাগত যোগ্যতার অবশ্যই আলাদা মর্যাদা রয়েছে তবে শিক্ষাগত যোগ্যতা দিয়ে সব কিছুর মাপ করা যায় না। সাংবাদিকতার এথিকস বা নীতিমালায় শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়টি নিয়ে পরিস্কার কিছু বলা নেই।'
তিনি আরও বলেন, 'সাহেদদের মতো ব্যক্তিরা মিডিয়ায় কিভাবে প্রবেশ করে সেই বিষয়ে আমাদের এখন নজর দেওয়া উচিৎ। মিডিয়ায় যারা আসবে বা মিডিয়া ব্যক্তিত্বদের যোগ্যতা যাচাই বাছাই করার জন্য তো লোক রয়েছে। তারা এমন সাহেদদের মতো প্রতারকদের সুযোগ করে দিচ্ছে কিনা সেই বিষয়টা আমাদের নজরে রাখতে হবে।'
টাকার বিনিময়ে কি সাহেদদের মতো প্রতারক মিডিয়ায় সুযোগ পাচ্ছে? এমন প্রশ্নের জবাবে সাবেক তথ্য কমিশনার বলেন, 'আমার ঠিক জানা নেই কিন্তু হতেও পারে। মাঝে মাঝে অবশ্য অভিযোগ আসে যে, মিডিয়া বা টকশোতে এমন লোককে ডাকা হয় যারা টাকা পয়সার বিনিময়ে এই কাজটা করে এমন নানা ধরনের অভিযোগও আসে। অনেক বিখ্যাত উপস্থাপক আছেন যারা টাকা পয়সার বিনিময়ে এই কাজটি করে থাকেন বলে অনেকে সন্দেহ করেন এবং অভিযোগ করেন। অনেক টকশোতে দেখা গেছে এমন ব্যক্তিদের আনা হয় যাদের কথা বলারও যোগ্যতা নেই বা দৃষ্টি পর্যায়ে তার কোন ব্যাকগ্রাউন্ড নেই। এমন ব্যক্তিদের টকশোতে বিভিন্ন উপস্থাপক, যারা প্রযোজক এবং গণমাধ্যেমের মালিকানায় আছেন তারা তাদেরকে টাকা-পয়সা বা অন্য কোন স্বার্থে তাদের প্রমোট করেন। প্রোপার জায়গায় প্রোপার মানুষকে না আনাটাও এক প্রকার ক্রাইম।'
মিডিয়ায় কি তবে অতিথি বাণিজ্য চলছে? আর চললে এদের কারা সুযোগ করে দিচ্ছে? এমন প্রশ্নের জবাবে মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মাসুদ কামাল সান নিউজকে বলেন, 'মিডিয়াতে অতিথি বাণিজ্য চলছে- এটা ঢালাও ভাবে বলা যাবে না। তবে ভিজ্যুয়াল মিডিয়ার টকশো গুলোতে যে সকল অতিথিকে আনা হয়, তার সবই যে যোগ্যতার ভিত্তিতে আনা হয়- সেটাও নয়। যে বিষয়ের ওপর আলোচনা হবে, সে বিষয়ে এক্সপার্ট না হওয়া সত্ত্বেও কিছু কিছু অতিথিকে ব্যক্তিগত পরিচয়, মালিকপক্ষ বা উর্ধতনের অনুরোধে আনা হয়ে থাকে।
তিনি বলেন, অনেক সময় রাজনৈতিক বিশেষ মহলের অনুরোধ বা চাপও অতিথি নির্বাচনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এরকম চাপে অনেক ভালো অতিথিকে আবার বাদও দিতে হয়। সবমিলিয়ে একটা অনিয়ম চলেই। আর এমন অনিয়ম চলে বলেই, সেই সুযোগটা অনুষ্ঠানের অ্যাংকর বা প্রযোজকরাও অনেক সময় নেয়। কোথাও কোথাও নগদ অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে অতিথি হওয়ার ঘটনা দেখা যায়।
তিনি আরও বলেন, 'এই অনিয়মগুলো যে নিয়মিত চলছে- এর জন্য বিচ্ছিন্নভাবে দুএকজনকে দায়ী করা ঠিক হবে না। সামগ্রিকভাবে মিডিয়ার মালিকপক্ষই এর জন্য দায়ী। মনে রাখতে হবে, আমাদের এখানে মিডিয়াগুলোর মালিকানার সঙ্গে বিভিন্ন ব্যবসায়ীরা জড়িত রয়েছে। তাদের সেই ব্যবসায়িক স্বার্থেও অনেক সময় গুরুত্বহীন এবং অপ্রাসঙ্গিক ব্যক্তিদের অতিথি হিসাবে আনতে হয়। নিজেরা যেহেতু তারা সাংবাদিকতার নীতিমালা ভঙ্গ করে, তাই অন্যরা যখন সেই একই কাজ করে তখন তাতে বাধা দেওয়ার নৈতিক জোর আর তাদের থাকে না।'
আপনি যে জায়গাগুলোয় কাজ করেছেন তাতে এমন অনিয়ম দেখেছেন কি না? আর দেখলে সে বিষয়ে কথা বলার সুযোগ রয়েছে কি?
এমন প্রশ্নের জবাবে মাসুদ কামাল বলেন, আমি এই দেশেরই মিডিয়াতে কাজ করেছি। তাই এসব অনিয়ম না দেখার কোনই কারণ নেই। আমি একটি টেলিভিশনে টানা দশ বছর কাজ করেছি। সেখানে বিভিন্ন টকশো বা আলোচনা অনুষ্ঠানে মোঃ সাহেদ সহ অনেক অপ্রাসঙ্গিক অতিথি আসতো। এই সাহেদের ক্ষেত্রেও আমি তৎকালীন হেড অব নিউজের কাছে প্রতিবাদ করেছি। তিনিও অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছেন। বলেছেন- উপর থেকে ফোন এসেছে। তাদের নির্দেশেই সাহেদকে অতিথি করতে তিনি বাধ্য হচ্ছেন। এখন এই “উপর” বলতে তিনি কাকে বুঝিয়েছেন, মালিকপক্ষকে নাকি রাজনৈতিক কোন দলকে, নাকি বায়বীয় কোন উৎসকে- সেটা আমি বলতে পারবো না।
মিডিয়ার ওপর শিক্ষার্থীদের আস্থা-
এখনকার শিক্ষার্থী বা তরুণদের মিডিয়ার উপর কেমন আস্থা রয়েছে তা জানার জন্য সান নিউজ কথা বলেছেন দেশের শিক্ষার্থীদের সাথে। এবং মিডিয়া নিয়ে শিক্ষার্থীদের মনের কথা তুলে ধরা হয়েছে।
জাহাঙ্গীনগরের পদার্থ বিভাগের শিক্ষার্থী তামিম বলেন, মিডিয়াতে যারা আসে আমরা চাই তাদের ব্যাকগ্রাউন্ড খুব ভালো ভাবে চেক করে নিয়ে আসা হোক কারণ মিডিয়াতে সাহেদ সাহেবদের মতো আরও অনেক মানুষ আসতে পারে। আর এসব মানুষদের কথা বার্তা সাধারণ মানুষ শুনে মিডিয়ার কারণে। মিডিয়া সাধারণ মানুষের কাছে এদের ফেস ভেলু বাড়িয়ে দেয়। তাই সাধারণ মানুষ যাতে ধোঁকার শিকার না হয় সেই বিষয়ে মিডিয়াকে নজর রাখতে হবে।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পেট্রোলিয়াম ও খনি কৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী ওয়াহেদ চৌধুরী বলেন, আসলে আমি অবাক হয়েছি দেশের প্রায় প্রত্যেক মিডিয়ায় সাহেদকে দেখে। এটা আমাদের জন্য সত্যি লজ্জার কথা। আসলে তারা কেমনে আসে তাতো আমরা জানি না কিন্তু এমন মানুষ যাতে আর মিডিয়ায় না আসতে পারে এটাই আমাদের কাম্য এবং আর একটি বিষয় সাহেদদের মতো আরও মানুষ রয়েছে কিনা তা দেখার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি।
মিডিয়া নিয়ে সাধারণ মানুষের কথা-
সাধারণ মানুষের মনের কথা জানতে তাদের দ্বারেও গিয়েছে সান নিউজ। মিডিয়া নিয়ে তাদের চাওয়া পাওয়া ও তাদের কথা তুলে ধরার চেষ্টা করেছে।
শাওন নামের এক ব্যক্তি সান নিউজকে বলেন, বর্তমানে আমরা টেলিভিশনে যে টকশো গুলো দেখি তাতে আমরা পূর্বের টকশো গুলোর মতো ইন্টারেস্ট পাই না। আগে যেই টকশোগুলো হতো তাতে জ্ঞাণী ব্যক্তিরা আসতেন। আমরা বলতে গেলে তাদের বেশির অধিকাংশকেই চিনতাম। এবং তাদের কথা শুনতে ভালো লাগতো। এখন আসলে আগের মতো টকশোগুলো হয় না।
কাওছার নামের একজন বলেন, ভাই আগে নিউজ বা টকশো দেখার জন্য টিভির সামনে বসে থাকতাম। মনে করতাম অনেক কিছু জানতে পারতেছি কিন্তু এখন আর ভালো লাগে না। তবে এখন কিছু টকশো বা অনুষ্ঠান হয় যা দেখতে বা শুনতে ভালো লাগে। অবশ্য তা খুবই কম।
দেশের গণমাধ্যমগুলো দেশের গণমানুষের কথা বলবে। পুরো দেশের মানুষদের দিবে সত্য খবর পাশাপাশি এতে যেন কোন প্রতারকের সৃষ্টি হতে না পারে সেই বিষয়ে নজর রাখবে। এখনও দেশের মানুষ বিশ্বাস রাখে গণমাধ্যম বা মিডিয়ার ওপর। সেই বিশ্বাসে যেন চিড় না ধরে সেটাই সাধারণ মানুষের চাওয়া মিডিয়ার কাছে।
সান নিউজ/ আরএইচ