সান নিউজ ডেস্ক:
পাহাড়ের ঢালে থরে থরে সাজানো সবুজের সমারোহ থেকে রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে হাড়ভাঙা খাটুনিতে দুটি পাতা একটি কুড়ি সংগ্রহ করে শৌখিন মানুষের কাপে চা পৌঁছে দিচ্ছেন যে মাানুষগুলো, এই সভ্য সমাজে আজও বঞ্চিত সেই চা শ্রমিকেরা।
বর্তমানে বিশ্বের দশম বৃহৎ চা উৎপাদনকারী আর রপ্তানিতে নবম স্থান অধিকারী হিসেবে তালিকায় নাম লিখিয়েছে বাংলাদেশ। ভেঙেছে নিজের ১৬৫ বছরের রেকর্ড। দেশের চা-খাতের এই সফলতার পেছনে রয়েছে শ্রমিকের রক্ত পানি করা কষ্ট আর বাগান মালিকের নির্মমতার গল্প।
২০১৯ সালে চা-শিল্পের ১৬৫ বছরের ইতিহাসে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ চা উৎপাদনের নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছে বাংলাদেশ।
চা বোর্ড সূত্র বলছে, গত বছর দেশে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ৮ কোটি কেজি হলেও ডিসেম্বর পর্যন্ত উৎপাদিত হয়েছে ৯৫ মিলিয়ন বা ৯ কোটি ৫০ লাখ কেজি, যা লক্ষ্যমাত্রার চাইতে প্রায় ১ কোটি ৫০ লাখ চা পাতার উৎপাদন বেশি হয়েছে।
তবে বাংলাদেশ টি অ্যাসোসিয়েশন সিলেট ব্রাঞ্চের চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ শিবলী জানান, চায়ের উৎপাদন বেশ ভাল হলেও চায়ের ন্যায্য মূল্য আমরা পাচ্ছি না।কারণ ভারত থেকে কম মূল্যে নিন্মমানের চা পাতা চোরাইপথে বাংলাদেশে প্রবেশ করে আমাদের চায়ের বাজার নষ্ট করছে।
বাংলাদেশ চা বোর্ডের প্রকল্প উন্নয়ন ইউনিটের (পিডিইউ) ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ড. একে এম রফিকুল হক বলেন, আবারও চা উৎপাদনে নতুন করে রেকর্ড সৃষ্টি করেছে বাংলাদেশ। ২০১৯ সালের নভেম্বর পর্যন্ত মোট উৎপাদন ছিল ৯ কোটি কেজি চা পাতা । তার আগের বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালের নভেম্বরে এর পরিমাণ ছিল ৭ কোটি ৬০ লাখ কেজি। গত বছরের তুলনায় এ বছর একই সময়ে ১৪ মিলিয়ন অর্থাৎ ১ কোটি ৪০ লাখ কেজি চা বেশি উৎপাদন হয়েছে। এটিই চায়ের ইতিহাসে দেশে সেরা রেকর্ড।
এর আগে ২০১৬ সালে আগের সব রেকর্ড ভেঙে ১৬২ বছরের চা-শিল্পের ইতিহাসে দেশের সর্বোচ্চ চা উৎপাদন হয়েছিল ৮৫ দশমিক ৫ মিলিয়ন অর্থাৎ ৮ কোটি ৫৫ লাখ কেজি চা পাতা।
নতুন নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার আর শ্রমিকদের অত্যাধুনিক প্রশিক্ষণসহ বেশ কিছু কারণে বাংলাদেশে উত্তরোত্তর চায়ের উৎপাদন বাড়ছে সরকারী-বেসরকারী পর্যায়ে।
সময়ের সঙ্গে চা উৎপাদন বাড়লেও বাড়েনি চা শ্রমিকদের মজুরি। বংশানুক্রমে সমাজের মূলধারা থেকে আজও বিছিন্ন চা শ্রমিকরা। নেই নিজেদের ভূমির অধিকার, জীবন ধারণের মৌলিক অধিকার থেকেও বঞ্চিত তারা।
১৮৫৪ সালে সিলেটের মালিনীছড়া চা বাগান প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলে চায়ের আবাদ শুরু। তখন এর সিংহভাগের মালিকই ছিল ব্রিটিশ বণিকরা। সে সময় ভারতের বিহার, উড়িষ্যা, অন্ধ্রপ্রদেশ, উত্তর প্রদেশসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে নিচু বর্ণের হিন্দু, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষকে চা চাষের জন্য আসাম ও বৃহত্তর শ্রীহট্ট ( বর্তমান সিলেট)এ নিয়ে আসা হয়। মাইলের পর মাইল পাহাড়ি টিলা আর ঢাল পরিষ্কার করে চা বাগানের সূত্রপাত করেছিল তারাই। মাঝে পেরিয়ে গেছে অনেক সময়। বৃটিশদের হাত থেকে মুক্ত হল ভারতবর্ষে। ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান হল, পাকিস্তান ভেঙে হল বাংলাদেশ। কিন্তু হাড়ভাঙা খাটুনীতে শ্রমিকদের চা উৎপাদনের কাহিনীটা আছে যেন ঠিক আগের মতোই।
চা বোর্ডের হিসেবে পুরো বাংলাদেশে চা বাগান রয়েছে মোট ১৬২টি৷ তার মধ্যে শ্রীমঙ্গল উপজেলার বাগানসহ মৌলভীবাজার জেলায় মোট বাগানের সংখ্যা ৯০টির মতো৷ বৃহত্তর সিলেটেের শতাধিক চা বাগানে কর্মরত আছেন এক লাখ আঠারো হাজার শ্রমিক। এই শ্রমিকদের ৬৪ শতাংশই নারী। প্রতিদিন প্রত্যেক শ্রমিককে চা পাতা তুলতে হয় ১৮ থেকে ২৪ কেজি করে।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে চা শ্রমিকদের মজুরি সাপ্তাহিক কিস্তিতে দেয়া হলেও এখন দেয়া হয় দৈনিক ভিত্তিতে। ২০১৩ সালে চা-শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ছিল ৬৯ টাকা। ২০১৮ সালে তা এসে দাঁড়ায় ১০২ টাকায়। দুর্মূল্যের বাজারে সামান্য এই টাকায় পরিবার নিয়ে জীবন যাপন করাটাই যেন এক একজন শ্রমিকের জন্য আরেক বোঝা।
৪০ বছরের চিত্রা হাজরা, চার ছেলে ও এক মেয়ে তার। স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করে তাকে ছেড়ে চলে গেছে অনেক আগেই। বড় ছেলে বিয়ে করেছে, থাকে আলাদা। বাকি তিন ছেলে এবং এক মেয়ে নিয়ে তার সংসার। চিত্রা সারাদিন কাজ করে যে টাকা পান তা দিয়ে সংসার চলে তার একটা ঘোরের মধ্য দিয়ে। একবেলা খান তো বারেক বেলা উপোস থাকতে হয়।
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক দীপংকর রায়। তিন পুরুষ ধরে তার পরিবারের সদস্যরা কাজ করছেন চা বাগানে।
তিনি জানান, ২০১৮ সালের চুক্তি অনুযায়ী ৮ ঘন্টা শ্রমে ১০২ টাকা করে দেয়া হয়৷ কিন্তু ওই ১০২ টাকার বিনিময়ে কোন কোন মালিক ২৪ থেকে ২৬ কেজি পর্যন্ত চা পাতা তুলতে বাধ্য করে শ্রমিকদেরকে৷ বাগানে নির্দিষ্ট ওজনের কম-বেশি চা পাতা তুললে ওজনের সঙ্গে মজুরিরও হেরফের হয়।
চা শ্রমিক কাজল রায় জানান, তাঁর কর্মস্থল ডানকান ব্রাদার্সের মালিকানাধীন করিমপুর চা বাগানে ২০ কেজি করে চা তুলতে হয় প্রত্যেক শ্রমিককে৷ বেশি তুললে প্রতি কেজিতে দেওয়া হয় মাত্র দেড় টাকা। আর এর কম তুললে কেজি প্রতি কেটে নেওয়া হয় সাত টাকা করে৷
শ্রমিক নেতা দীপংকর রায় বলেন, বর্তমানে চা বাগানে শিশু শ্রম অনেকাংশে কমলেও শিক্ষার সুযোগ তেমন একটা নেই ৷ চা বাগানে ১৬ থেকে ১৭টি সরকারি প্রাইমারি স্কুল আছে৷ কিন্তু মালিকপক্ষের বিভিন্ন কলাকৌশলের কারণে শ্রমিকের কাছে সন্তানের পড়াশোনার গুরুত্বটা যেন অনেক গৌণই হয়ে পড়ে।
নিজস্ব চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থা তেমন একটা না থাকায় ডাক্তার দেখাতে হলে এলাকার শ্রমিকদের মৌলভীবাজার বা সিলেটে যেতে হয়।
তবে আশার কথা হলো, এতো সীমাবদ্ধতার মধ্যেও এই জনগোষ্ঠির অনেকেই বেড়িয়ে আসছে সমাজের মূল ধারায়। যারা একটু বেশি সচেতন ততাদের অনেকের সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিশেষ কোটায় বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারী সংস্থা, বাগান ব্যবস্থাপনা, মিডিয়া সহ বিভিন্ন যায়গায় নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
তাদেরই একজন অনিল পাল। তার স্বজনরা এখনো বাগানের শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন। কিন্তু তিনি নিজে একটা বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের হয়ে সিলেট বিভাগীয় ক্যামেরা ম্যান হিসেবে কর্মরত আছেন। অনিল বলেন, আমি এখন এটিএন বাংলার ক্যামেরাম্যান হিসেবে কাজ করছি। আমার মতো অনেকেই বিভিন্ন মাধ্যমে সম্মানের সঙ্গে কাজ করছে। কেউ শিক্ষকতা, কেউ এনজিও, কেউ বা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। অনেকে মেডিক্যাল ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করছেন। বাগানে সমস্যা থাকলেও আমরা সেটা নিজের যোগ্যতায় পার করতে পেরেছি।
সান নিউজ/সালি