বিভাষ দত্ত, ফরিদপুর থেকে :
সমাজের কল্যাণে একটি ভালো কাজ দিয়ে প্রতিদিন শুরু করেন স্কুলশিক্ষক মো. নূরুল ইসলাম। আর প্রতিমাসে পরিকল্পনা করে বড় ধরনের একটি ভালো কাজ করেন। সেসব ভালো কাজগুলোও ব্যতিক্রমধর্মী, যেখানে প্রকাশিত প্রকৃতি ও মানুষের প্রতি ফরিদপুর শহরের এই যুবকের অকৃত্রিম ভালোবাসাই।
এ পর্যন্ত করা নূরুলের ভালো কাজের তালিকা দেখলেই বোঝা যায়, কিভাবে এবং কেন তিনি মানুষের মন জয় করে চলেছেন। রিকশাচালক, দুস্থ ও ভিক্ষুকদের মাঝে সকালের নাস্তা, সেমাই, চিনি ও গুঁড়োদুধ বিতরণ ছাড়াও বাজার করে দেওয়া ও চিকিৎসায় আর্থিক সহায়তা দিয়েছেন তিনি, খাইয়েছেন চায়নিজ খাবারও। মাদ্রাসায় দিয়েছেন নগদ টাকা, দরিদ্র ছাত্রকে কিনে দিয়েছেন বই। করোনাকালে দুস্থ ও দরিদ্র পরিবারের মাঝে বিতরণ করেছেন চাল, ডাল, লবণ ও সাবান। প্রকৃতি ও নদীরক্ষায় রাধাচূড়া ও কৃষ্ণচূড়ার গাছ রোপন, খেঁজুর ও তালবীজ বপণ এবং জনসচেতনতা বাড়াতে নদীতে প্লাস্টিক বর্জ্য না ফেলার আহ্বান সম্বলিত বিলবোর্ড স্থাপনও তার ভালো কাজের দৃষ্টান্ত।
ফরিদপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের সহকারী শিক্ষক মো. নুরুল ইসলাম শহরের দক্ষিণ টেপাখোলা লালের মোড় এলাকার বাসিন্দা। বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. ফকির আব্দুর রহমান ও মা নূরজাহান বেগমের প্রেরণায় এবং স্ত্রী- এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে করা নূরুলের ভালো কাজগুলো আশা জাগাচ্ছে ফরিদপুরের মানুষের মনে।
শৈশব থেকেই গরিব ও সাধারণ মানুষের প্রতি অগাধ ভালোবাসা নূরুলের, বৃক্ষের প্রতিও প্রবল আসক্তি। যেখানেই বেড়াতে যেতেন, সেখান থেকেই বিভিন্ন গাছের চারা এনে বাড়ির আঙিনায় লাগাতেন। দরিদ্র মানুষকে সহযোগিতা করেছেন, করছেন এবং করে যাবেন আমৃত্যু- এমনটাই পণ করেছেন তিনি।
কেন ভালো কাজ করার এই পণ? নূরুল জানান, ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে বাজারে যাওয়ার সময় হাত পেতে থাকা ভিক্ষুক দেখে মনে খুব কষ্ট পেয়েছিলেন। পকেটে যা খুচরা পয়সা ছিলো তা তিনি বিলাতে থাকেন। এদিকে তার বাবা হাঁটতে হাঁটতে বাজারের ভেতরে চলে গিয়ে তাকে খুঁজতে থাকেন। অনেক খুঁজে দেখতে পান, ছেলে তার ভিক্ষুকদের পয়সা দিচ্ছেন।
আরো একটি ঘটনা খুব নাড়া দেয় নূরুলকে। একদিন তিনি স্কুলে যাওয়ার পথে দেখতে পান, এজন মানুষ ডাস্টবিন থেকে খাবার কুড়িয়ে খাচ্ছেন। সঙ্গে সঙ্গে পকেটে থাকা টিফিনের দশটাকা দিয়ে তাকে নাস্তা করান।
নূরুল আরও জানান, গত বছরের একটি ঘটনার পর তিনি সিদ্ধান্ত নেন, নিজস্ব অর্থায়নে প্রতিমাসে অন্তত একটি ভালো কাজ করবেন। সে লক্ষ্যেই এগিয়ে যাচ্ছেন।
এ পর্যন্ত প্রতিমাসে করা নূরুলের ভালো কাজগুলো হচ্ছে- গত বছরের এপ্রিলে ২০০ জন রিকশাচালককে সকালের নাস্তা পাউরুটি, সিদ্ধ ডিম ও কলা বিতরণ, মে মাসে ৪০ জন দুস্থ মানুষকে সেমাই, চিনি ও গুড়োদুধ বিতরণ, জুনে ২০টি রাধাচুড়া ও কৃষ্ণচুড়ার গাছ শহরের বিভিন্ন স্থানে রোপণ, জুলাইয়ে একজন রিকশাচালককে মাসের বাজার করে দেওয়া, আগস্টে একটি মাদ্রাসায় নগদ টাকা প্রদান, সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় শহরজুড়ে এক হাজার ১৪১টি তালবীজ বপণ, অক্টোবরে মাসে এক ছাত্রের বই কিনে দেওয়া, নভেম্বরে ৫০ জন রিকশাচালক ও ভিক্ষুককে চায়নিজ খাওয়ানো এবং ডিসেম্বরে একজন দুস্থ মানুষের চিকিৎসা খরচ যোগানো। এ বছরের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে দুইজন রিকশাচালকের বাজার করে দেওয়া, মার্চে নদীর দূষণ কমাতে এবং জনসচেতনতা বাড়াতে ‘দয়া করে নদীতে কেউ প্লাস্টিক বর্জ্য ফেলবেন না, নদী না বাঁচলে আমরা বাঁচবো না, নদী বাঁচলে আমরা বাঁচবো’- স্লোগান সম্বলিত দুইটি স্থায়ী বিলবোর্ড ফরিদপুরের পদ্মারপাড় ধলার মোড় ও ভূঁইয়াবাড়ি ঘাটে স্থাপন এবং জুনে শহরের সড়ক ডিভাইডারে দুই হাজারটি খেঁজুরবীজ বপণ করেছেন তিনি। করোনাকালে এপ্রিল মাসে দুস্থ ও দরিদ্র ২৫টি পরিবারের মাঝে চাল, ডাল, লবণ ও সাবান বিতরণ করেছেন। এই জুলাই মাসে ২৫টি কৃষ্ণচুড়া গাছ শহরের বিভিন্ন স্থানে লাগানোর ইচ্ছা আছে তার।
শিক্ষক নূরুল ইসলাম বলেন, ‘আমি একজন ক্ষুদ্র মানুষ। আমার একার পক্ষে কিছুই করা সম্ভব নয়। আত্মতৃপ্তি থেকে মানুষকে সাহায্য আর প্রকৃতিতে সবুজায়নের চেষ্টা করে যাচ্ছি, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় তালগাছ রোপণ করেছি। আমার উদ্দেশ্য, আমাকে দেখে সমাজের বিত্তশালীরা অনুপ্রাণিত হোন। সবাই মিলে ভালো ভালো কাজ করলে দেশে দারিদ্র্য কমে যাবে, প্রকৃতি ফিরে পাবে তার নিজস্ব রূপ, দূষণ কমে যাবে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবার্ষিকী মুজিব বর্ষ উপলক্ষ্যে এ বছরের সব কাজ জাতির পিতার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেছেন বলেও জানান মানুষ গড়ার এই কারিগর।
নূরুল বলেন, ‘দেশে করোনা দুর্যোগ ও সংকট চলছে। এই সময় প্রতিবেশীদের পাশে দাঁড়ানো আমাদের দায়িত্ব। করোনা মোকাবেলায় কর্মহীন হয়ে পড়া প্রতিবেশীদের দিকে সামর্থ্যবানদের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে, তবেই সবাই মিলে ভালো থাকা যাবে।’
‘একজন শিক্ষক হিসেবে প্রতিবেশীদের সঙ্গে আছি, আপনিও অসুবিধায় থাকা প্রতিবেশীদের সঙ্গে থাকুন’- এই আহ্বানও তার।
চায়নিজ খাবার খেতে আসা শহরের গুহলক্ষ্মীপুরের ভিক্ষুক হাজেরা বিবি (৪৬) বলেন, ‘চায়নিজের কথা মানুষের মুখে মুখেই এতোদিন শুনেছি, খাওয়া হয়নি কখনো। এখন খেলাম, বুঝলাম চায়নিজ কারো কয়।’
ফরিদপুর শহরে রিকশা চালাতে আসা রাজবাড়ী সদর উপজেলার বসন্তপুর গ্রামের আফজাল ফকির বলেন, ‘ভোরবেলা বাড়ি থেকে রিকশা নিয়ে বের হয়েছি। ঠিকমতো সকালের নাস্তা খেয়ে আসতে পারিনি। এ নাস্তা পেয়ে আমার উপকার হলো। এখন আরো তিন/চার ঘণ্টা নিশ্চিন্তে রিকশা চালাতে পারবো।’
শিক্ষাবিদ ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব প্রফেসর আলতাফ হোসেন বলেন, ‘মানুষের ভালোবাসা পাওয়া খুব সহজ কাজ নয়। অনেক কিছুর বিনিময়ে এটি অর্জন করতে হয়। বৃক্ষপ্রেমিক নূরুল ইসলাম শহরের মানুষের অকুণ্ঠ ভালোবাসার অমূল্য সেই স্থানটিই পেয়ে চলেছেন। প্রচারবিমুখ এই যুবক প্রতিমাসের কার্যক্রমের পাশাপাশি নীরবে আরো কিছু সাহায্য-সহযোগিতা করেন। তার ভালো কাজগুলো দেখেই বোঝা যায় যে, প্রবল আন্তরিকতা আর বুকের ভেতরের ভালোবাসার আকাশ ছাড়া এগুলো সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। নূরুল ইসলাম তা পেরেছেন এবং করে দেখিয়েছেন। তাই ফরিদপুরের মানুষের হৃদয়ে সুউচ্চতায় অবস্থান করতেও পেরেছেন।’
‘নূরুল ইসলামের বৃক্ষপ্রেম, মানবপ্রেম ও দেশপ্রেম এলাকার আরও দশজনের কাজের প্রেরণা হয়ে উঠুক’- আশাবাদ এই শিক্ষাবিদেরও।
নুরুল ইসলামের ছাত্র অরিন্দম ঘোষ বলেন, ‘স্যার দরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থী, অসুস্থ ও দরিদ্র মানুষের কল্যাণে নিয়মিত কাজ করেন। ঈদসহ বিভিন্ন উৎসবে দরিদ্র মানুষের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করেন নেন। দেশি খেঁজুর গাছ ও খেঁজুরের গুড়ের জন্য বিখ্যাত ফরিদপুর জেলা থেকে যখন এই গাছটিই বিলুপ্ত হতে চলেছিল, ঠিক তখনই স্যার দুই হাজারের বেশি খেঁজুরবীজ রোপণ করেছেন।এ পর্যন্ত যতো গাছ লাগিয়েছেন, সেগুলো বড় না হওয়া পর্যন্ত নিয়মিত পরিচর্যাও করছেন তিনি। ফরিদপুরের ঐতিহ্য ধরে রাখা, শহরের সৌন্দর্য বাড়ানো আর পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় স্যারের এই কাজ তাই যুগ যুগ ধরে ভূমিকা রাখবে।’
‘স্যারের এসব কার্যতক্রমে আমরা তার শিক্ষার্থীরাও স্বপ্রণোদিত হয়ে হাত লাগাই, সহযোগিতা করি’- বলছিলেন নূরুল ইসলামের ছাত্র-ছাত্রী সৃষ্টি, ফাইজা, অর্থি, সাজিন, ফারাতুল, নাঈমসহ আরো অনেকেও।
সান নিউজ/ এআর