নিজস্ব প্রতিবেদক:
নির্বাচন এলেই প্রার্থীরা ছোটেন ভোটারদের দ্বারগোড়ায়, দিতে থাকেন প্রতিশ্রুতির পর প্রতিশ্রুতি। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনও তার ব্যতিক্রম নয়।। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণের মেয়র প্রার্থীরা যাচ্ছেন ভোটারদের কাছে, যথারীতি দিচ্ছেন ভালবাসা ঝরানো রঙিন সব প্রতিশ্রুতি। যদিও প্রার্থীরা এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেননি তাদের নির্বাচনী ইশতেহার। কিন্ত এসব প্রতিশ্রুতির কতটা বাস্তবায়ন করতে পারবেন তারা? সাবেক মেয়ররাই বা কতটা বাস্তবায়ন করতে পেরেছিলেন? সে প্রশ্ন এখন মানুষের মুখে মুখে।
এবার যানজট নিরসনে ডিজিটাল পদ্ধতিতে ট্রাফিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা, ডিজিটাল পরিবহন ব্যবস্থা, আইন-শৃঙ্খলার উন্নয়ন, পরিকল্পিত নগরায়ন ও নিরাপদ শহর গড়ে তোলাসহ প্রতিশ্রুতির ঝুড়ি মেলে ধরেছেন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দলীয় মেয়র প্রার্থীরা।
তবে এসব প্রতিশ্রুতির অনেক বিষয়ে আকৃষ্ট হচ্ছেন না নগরের সচেতন মানুষেরা। তারা বলছেন, এসব প্রতিশ্রুতির কিছু আছে মেয়রদের এখতিয়ারের বাইরে আবার কিছু বিষয় বাস্তবায়ন করতে পারাটা মেয়রদের একার পক্ষে সম্ভব নয়। অতিতে অন্যান মেয়রদের ক্ষেত্রেও তেমনটাই দেখা গেছে। আবার যেটুকু তাদের ক্ষমতার মধ্যে থাকে, তার বাস্তবায়নের সদিচ্ছা নিয়েও প্রশ্ন থেকে যায় অনেক সময়। সব মিলিয়ে নগরবাসীর নানাবিধ সমস্যা দূরীকরণে সিটি কর্পোরেশনের কাজ করার সক্ষমতা কতখানি আর ক্ষেত্র বিশেষ একক ক্ষমতা থাকলেও সেখানে প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে সদিচ্ছাও বা তাদের কতোটুকু, এসব প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে সচেতন মহলে।
মেয়র প্রার্থীদের কেউ কেউ দিচ্ছেন মহানগরকে নতুন করে পরিকল্পিতভাবে ঢেলে সাজানোর পতিশ্রুতি। কিন্ত ঢাকায় নগর পরিকল্পনা করে থাকে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ- রাজউক। এ ক্ষত্রে সিটি কর্পোরেশনের ভূমিকা কতটুকু? অন্যদিকে ভবন নির্মাণের অনুমোদনও দেয় রাজউক। ভবন নির্মাণের অনুমোদনের ক্ষেত্রে কোন ভূমিকা নেই সিটি কর্পোরেশনের। নির্মাণের সময় কোন নজরদারিও দেখা যায় না সিটি কর্পোরেশনের। কিন্তু নির্মাণ হলে পৌর কর নেয় কর্পোরেশন ।
অনেকেই প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন নিরাপদ নগরী গড়ে তোলার। অথচ আইন অনুযায়ী এ দায়িত্ব আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর হাতে। এ বাহিনী সিটি কর্পোরেশনের অধীনে নয়।
সিটি কর্পোরেশনের কার্যাবলী ৮/১ ধারায় বলা হয়েছে, নগরবাসীর ব্যবহারের জন্য পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করবে সিটি কর্পোরেশন। এ ক্ষেত্রে তাদের পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে। কিন্তু সিটি কর্পোরেশনের কোন অবকাঠামো নেই। পানি সরবরাহ করে থাকে ঢাকা ওয়াসা। এ কাজের জন্য ওয়াসার সাথে সমন্বয় করে কাজ করতে হবে সিটি কর্পোরেশনকে। পয়ঃনিষ্কাশনের ক্ষেত্রে দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশনের। এখানেও বিভিন্ন সংস্থার সাথে সমন্বয়ের করতে হবে।
মেয়রদেরও রয়েছে বিভিন্ন বাধ্যবাধকতা। ওয়ার্ডের কাউন্সিলরদের সাথে পরামর্শ করেই সিদ্ধান্ত নিতে হয় মেয়রকে। মেয়র একা কোন
সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। কিন্তু সিটি কর্পোরেশনকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে, যেন মেয়রই সবকিছু। তবে প্রয়োজনে মেয়র একাই কাইন্সীলরদের ছাড়াই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। কিন্ত পরবর্তী কাউন্সিলসভায় তার অনুমোদন করিয়ে নিতে হয়।
পুলিশ, ওয়াসা, রাজউকসহ প্রায় অর্ধশত প্রতিষ্ঠানের সাথে সমন্বয় করে কাজ করতে হয় সিটি কর্পোরেশনকে। নতুন যারা মেয়র নির্বাচিত হবেন তারা যদি এসব অধিদপ্তর ও প্রতিষ্ঠানের সাথে সমন্বয় করে কাজ করতে পারেন, তাহলে প্রতিশ্রুতির পুরোটা বাস্তবায়ন করতে না পারলেও অনেক ক্ষেত্রে সফল হবে বলে মনে করনে ঢাকা নগরবাসি। আগামীর মেয়ররা সে সমন্বয়টা কতটা করতে পারবেন তা ভবিষ্যত বলে দেবে। তবে অতিত অভিজ্ঞাতার আলোকে দেখা য়ায়, অধিকাংশ প্রতশ্রুতিই বাস্তবায়ন করতে পারেননি নগরপিতারা।
২০১৫ সালে ঢাকা দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন তার নির্বাচনী ইশতেহারে “পরিকল্পিতি উন্নয়ন, সুয়োগের সমতা ও দূষণমুক্ত নগরীসহ নানা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলনে। কতটা বস্তবায়ন করতে পরেছিলনে তিনি?
নিরাপদ ও দূষণমুক্ত আধুনিক ঢাকার প্রতিশ্রুতি দলেও তার শেষ সময়ে এসে রাজধানী ঢাকা হয়েছে বায়ুদূষণের শীর্ষ নগরী। গত ৯ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিশ্বের বায়ুমান যাচাই বিষয়ক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ‘এয়ার ভিজ্যুয়াল’ এর বায়ুমান সূচকে (একিউআই)
বায়ুদূষণে বিশ্বে প্রথম স্থান দখল নেয় ঢাকা। অথচ সাঈদ খোকন নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির অন্যতম ছিল দূষণমুক্ত ঢাকা।
শুধু সাঈদ খোকন নন, অতীতের বেশিরভাগ মেয়রই ঢাকার যানজট নিরসন, পানি-গ্যাস ও বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধান, পরিচ্ছন্ন-দূষণমুক্ত ও স্বাস্থ্যকর মহানগরী, নাব্য ও নিরাপদ বুড়িগঙ্গা, দুর্নীতি সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজের রোধসহ নানা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে নির্বাচনী প্রচারে। কিন্তু কতটা পেরেছিলেন তা বাস্তবতার দিকে চোখ মেললেই বোঝা যায় খুব সহজে।
তবে, এর ব্যতিক্রমও রয়েছে। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন বিভক্ত হওয়ার পর ২০১৪-তে আওয়ামী লীগের টিকেটে ঢাকা উত্তরের প্রথম মেয়র নির্বাচিত আনিসুল হক। নগরবাসীর নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করতে নিয়েছিলেন নানা পরিকল্পনা। গাবতলীর মতো ব্যস্ততম জায়গাকে যানজট মুক্ত করা আর তেজগাঁও শিল্প এলাকা থেকে দীর্ঘদিনের সমস্যা হয়ে দািঁড়িয়ে থাকা ট্রাকস্ট্যান্ড সরিয়ে রাজনৈতিক নেতাদের চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন- সদিচ্ছা থাকলে অনেক কিছুই করা সম্ভব মানুষের জন্য। ওই এলাকা করেছিলেন যানজট মুক্ত। তার সময়ে উত্তরায় কমে আসে চাঁদাবাজি। মশার প্রকোপ উত্তরে কমিয়ে আনতে নানাবিধ কার্যক্রম হাতে নিয়ে সফলও হয়েছিলেন অনেকটা। কিন্তু একই সময়ে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে মশার অত্যাচারটা বাড়তে থাকে উদ্বেগজনকভাবে।
একই সাথে তিনি গুরুত্ব দিচ্ছিলেন সিটি কর্পোরেশনের অভ্যন্তরীণ কর্ম ব্যবস্থাপনা, সুশাসন ও জবাবদিহিতা ওপর। পাশাপাশি জোর দিচ্ছিলেন কর্পোরেশনের সক্ষমতা বৃদ্ধি ওপর। তাই প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক হয়ে উঠেছিলেন সময়ের জনপ্রিয় মেয়র।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ী মাজহারুল ইসলাম বলেন, প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক সফল হতে পারলে অন্যরা কেন পারবে না। নিশ্চই অন্যদের মধ্যে অনেক বিষয়ে ঘাটতি রয়েছে। ইচ্ছা থাকলে সবই সম্ভব।
আরেক ব্যবসায়ী রফিক সরকার বলেন, তেজগাঁও শিল্প এলাকা থেকে ট্রাকস্ট্যান্ড সরিয়ে দিয়েছিলেন আনিসুল হক। তার মৃত্যুর পর আবারও ট্রাক স্ট্যান্ড হয়েছে সেখানে। এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়নি কেউ। একজন ভালো কাজ করলে উত্তরসূরীদের তার ধারাবাহিকতা ধরে রাখাটা অবশ্য কর্তব্যের মধ্যে পড়ে।