নিজস্ব প্রতিবেদক: ‘মুক্তির মহানায়ক’ স্বাধীনতার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১০২তম জন্মদিন আজ। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ রাত ৮টায় তৎকালীন ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেন শেখ বংশের আদরের ‘খোকা’। সেই খোকা ধীরে ধীরে হয়ে উঠেন বাঙালির ‘মুক্তির মহানায়ক’, ‘মুজিব ভাই’ পরে ‘বঙ্গবন্ধু’ ও জাতির পিতা।
মহান নেতার হাত ধরেই এসেছে বাঙালির স্বাধীনতা। বিশ্বের বুকে জন্ম নিয়েছে বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র। তবে জাতির অকৃতজ্ঞ কিছু সন্তান স্বাধীনতার স্থপতিকে হত্যা করে। এরপর দীর্ঘ দুই দশক ধরে ‘বঙ্গবন্ধু’র নামটিই মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে এই বাংলায়। শেখানো হয় মিথ্যা ইতিহাস। তবে সব মিথ্যাকে উড়িয়ে দিয়ে ইতিহাসের সত্য আবার নতুন প্রজন্মের সামনে এসেছে।
এদিকে বিগত বছরগুলোর ধারাবাহিকতায় এবারও জাতির পিতার জন্মদিন রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় ‘জাতীয় শিশু দিবস’ হিসেবে সারা দেশে উদযাপন করা হচ্ছে। এ দিনে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। এছাড়া দেশের সব সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং বিদেশস্থ বাংলাদেশ মিশনে এক সাথে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। রাষ্ট্রীয়ভাবে নানা কর্মসূচি পালন করা হবে। এ দিন সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। জাতির পিতার জন্মশত বার্ষিকী উপলক্ষে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে একবছরের জন্য মুজিববর্ষ হিসেবে ঘোষণা দেয় সরকার। তবে দেশে করোনা সংক্রমণের কারণে মুজিববর্ষ প্রথমে ২০২১ সালের ১৬ ডিসেম্বর এবং পরে আরেক দফা বাড়িয়ে ২০২২ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়।
জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি ও আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন এদিন বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এদিন ‘টুঙ্গিপাড়া হৃদয়ে পিতৃভূমি’ শীর্ষক বিশেষ অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয়েছে। কর্মসূচির মধ্যে আছে- সাড়ে ১২টায় জাতির পিতার সমাধি সৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন ও বিকাল আড়াইটায় আলোচনা সভা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
অপরদিকে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন উপলক্ষে আওয়ামী লীগ টুঙ্গিপাড়ায় সপ্তাহব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করবে। এবারের আয়োজনের নাম দেওয়া হয় ‘হৃদয়ে পিতৃভূমি’। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ও সারাদেশের সকল কার্যালয়ে জাতীয় এবং দলীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। জন্মদিন উপলক্ষে সকাল সাড়ে ৭টায় বঙ্গবন্ধু ভবনে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করে আওয়ামী লীগ।
রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে শ্রদ্ধার্ঘ অর্পণ করেন।
শেখ লুৎফর রহমান ও সায়েরা খাতুন দম্পতির তৃতীয় সন্তান ‘খোকা’ পরবর্তীতে হয়ে ওঠেন নির্যাতিত-নিপীড়িত বাঙালির মুক্তির মহানায়ক। গভীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, আত্মত্যাগ এবং জনগণের প্রতি অসাধারণ মমত্ববোধের কারণে হয়ে তিনি ওঠেন বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা।
কিশোর বয়স থেকেই রাজনৈতিক সচেতন ছিলেন তিনি। গোপালগঞ্জের মিশন স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে তৎকালীন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যোগ দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান প্রথমবারের মতো কারাগারে যান। ম্যাট্রিক পাসের পর কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে অধ্যয়নকালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং আবুল হাশিমের মতো রাজনৈতিক নেতাদের সান্নিধ্যে যান। এ নেতাদের সাহচার্যে তিনি নিজেকে ছাত্র ও যুব নেতা হিসেবে রাজনীতির অঙ্গনে প্রতিষ্ঠিত করেন।
১৯৪০ সালে সর্বভারতীয় মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনে যোগ দিয়ে তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। ১৯৪৬ সালে তিনি কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ (বর্তমানে মওলানা আজাদ কলেজ) ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হন।
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভের পরপরই ঢাকায় ফেরেন তিনি। রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনা নিয়ে অগ্রসর হন বঙ্গবন্ধু। সহকর্মীদের নিয়ে ১৯৪৮ সালে ছাত্রলীগ গঠন করেন। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী লীগ গঠন হলে যুগ্ম সম্পাদক হন বঙ্গবন্ধু।
পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনে স্বাধীনতার অভ্যুদয়ে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে মুক্তির মহামন্ত্রে উজ্জীবিত করে ধাপে ধাপে এগিয়ে নিয়ে গেছেন স্বাধীনতা ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্যে। ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় বাঙালি জাতির অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে আজীবন সোচ্চার এই অবিসংবাদিত নেতা রাজনৈতিক জীবনে অনেকবার কারাবরণ করেছেন।
তিনি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন ও ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন এবং ১৯৬৬ সালের ৬-দফা পরবর্তী সময়ে ১১ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানসহ প্রায় প্রতিটি গণতান্ত্রিক, স্বাধিকার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে বঙ্গবন্ধু উপাধি পান।
তাঁর সাহসী ও দূরদর্শী নেতৃত্বে বাঙালি জাতি ধাপে-ধাপে স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রস্তুতি নেয়। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জিত হলেও তৎকালীন পাকিস্তানের সামরিক জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তর না করে বাঙালি র ওপর নানা নির্যাতন শুরু করে। এরপর বঙ্গবন্ধু স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনকে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে প্রথমে স্বাধিকার আন্দোলন ও চূড়ান্তপর্বে স্বাধীনতার আন্দোলনে রূপ দেন।
একাত্তরের মার্চে নজিরবিহীন অসহযোগ আন্দোলন করেন বঙ্গবন্ধু। ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জনসমুদ্রে ঐতিহাসিক ভাষণে তিনি বজ্রকন্ঠে ঘোষণা দেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। এরই ধারাবাহিকতায় ২৬ মার্চে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে দেশ স্বাধীন হয়। আমরা পাই একটি পতাকা, একটি বাংলাদেশ।
আরও পড়ুন: টুঙ্গিপাড়ায় যাচ্ছেন রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রী
স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু বেশিদিন দেশ গঠনে কাজ করতে পারেননি। যুদ্ধ বিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনে বঙ্গবন্ধু যখন বিভিন্নমুখী কার্যক্রম গ্রহণ করতে শুরু করেন ঠিক সেই মুহূর্তে স্বাধীনতা যুদ্ধে পরাজিত শক্তি তাঁর বিরুদ্ধে ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র শুরু করে। ওই ষড়যন্ত্রেরই অংশ হিসেবে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তিনি ধানমন্ডির বাসভবনে কিছু বিপথগামী সেনা কর্মকর্তার হাতে সপরিবারে নিহত হন। সে সময় বিদেশে অবস্থান করায় বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা।
সাননিউজ/এমএসএ