নিজস্ব প্রতিনিধি:
আগামী অর্থবছরে প্রতিদিন সরকারের খরচ হবে গড়ে এক হাজার ৫৫৬ কোটি টাকা। সরকারের এই খরচ মেটাতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)-এর প্রতিদিন ৯০৪ কোটি টাকা জোগান দেওয়ার কথা। ফলে বাধ্য হয়ে সরকারকে ঋণ করতে হবে। ব্যাংকসহ অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন খাত থেকে সরকারের প্রতিদিনের ধারের অঙ্ক দাঁড়াবে ৩০১ কোটি টাকার মতো। এরমধ্যে শুধু ব্যাংক থেকেই নিতে হবে ২৩২ কোটি টাকা।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এনবিআরের পক্ষে প্রতিদিন ৭০০ কোটি টাকার বেশি জোগান দেওয়া সম্ভব হবে না। ফলে ঋণের পরিমাণ আরও বাড়বে। গত ১১ জুন জাতীয় সংসদে ২০২০-২১ অর্থবছরের ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা টাকার প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপন করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
প্রস্তাবিত বাজেটের তথ্য অনুযায়ী, সব মিলিয়ে আগামী ১২ মাসে সরকার সর্বসাকুল্যে ৩ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকা আয় করবে। এরমধ্যে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করতে হবে এনবিআর’কে। এটা চলতি অর্থবছরের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও ২৫ হাজার কোটি টাকা বেশি। বাজেটের তথ্য বলছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে সরকার অভ্যন্তরীণ খাত থেকে এক লাখ ৯ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য স্থির করেছে। এরমধ্যে ব্যাংকিং খাত থেকে সরকার ঋণ নেবে ৮৪ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা, সঞ্চয়পত্র থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা ও অন্যান্য খাত থেকে ঋণ নেওয়া হবে আরও পাঁচ হাজার কোটি টাকা।
বাজেটের এই তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, আগামী অর্থবছরে সরকারের প্রতিদিন খরচ হবে এক হাজার ৫৫৬ কোটি টাকা। এই খরচ মেটাতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) প্রতিদিন ৯০৪ কোটি টাকা জোগান দেবে। এর বাইরেও প্রতিদিন সরকারের আয় হবে ১৪২ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে সরকার প্রতিদিন আয় করতে পারবে ১ হাজার ৪৬ কোটি টাকা। ফলে সরকারের প্রতিদিন ঘাটতি থাকবে ৫১০ কোটি টাকার মতো। অবশ্য প্রতিদিনকার এই ঘাটতির খরচ মেটাতে সরকার অভ্যন্তরীণ খাত থেকে ৩০১ কোটি টাকা নেবে। এরমধ্যে প্রতিদিন ব্যাংক থেকেই নেবে ২৩২ কোটি টাকা। বাকি দৈনিক ২১৯ কোটি টাকা বিদেশ থেকে সাহায্য, অনুদান বা ঋণ হিসেবে আসার কথা।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান মনসুর বলেন, ‘প্রতিদিন গড়ে সর্বোচ্চ ৭শ’ থেকে সোয়া ৭শ’ কোটি টাকা আহরণ করার মতো সক্ষমতা আছে এনবিআরের। অর্থাৎ পুরো অর্থবছরে আড়াই লাখ থেকে ২ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা আহরণ হতে পারে। ফলে খরচ মেটাতে বাকি টাকাও ব্যাংক থেকেই নিতে হবে। এতে বেসরকারি খাতে ব্যাংক ঋণ দিতে পারবে না।’
তিনি উল্লেখ করেন, ‘দিনে ৯০০ কোটি টাকা রাজস্ব আহরণ পৃথিবীর অন্য যেকোনও দেশের জন্য স্বাভাবিক ঘটনা হলেও বাংলাদেশের অনেকটাই অসম্ভব । এ কারণে আগামী অর্থবছর শেষে দেখা যাবে ৬০ থেকে ৭০ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি রয়েছে।‘
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য বলছে, গত এপ্রিল মাসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ৮ হাজার ৯৩৮ কোটি ৮৯ লাখ টাকার ট্যাক্স রেভিনিউ আদায় করেছে। আগের বছরের একই সময়ে যা ছিল ১৯ হাজার ৬১৭ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। অর্থাৎ সরকারের রাজস্ব খাতে প্রবৃদ্ধি কমেছে ৫৪ দশমিক ৪৩ শতাংশ। রাজস্ব খাতের এমন নেতিবাচক পরিস্থিতির মধ্যেই এনবিআরকে আগামী অর্থবছরে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করার লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ প্রতি মাসে এনবিআরকে রাজস্ব আহরণ করতে হবে ২৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। আর প্রতিদিন তাদের রাজস্ব আহরণ করতে হবে ৯০৪ কোটি ১১ লাখ টাকা।
আর এই পরিমাণ অর্থ আদায় করতে না পারলে সরকারকে বাধ্য হয়ে ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে দৈনন্দিন কাজ সম্পন্ন করতে হবে। এক্ষেত্রে ব্যাংকের ওপর চাপ বাড়বে।
প্রস্তাবিত বাজেট অনুযায়ী, আগামী অর্থবছর ভ্যাট থেকে সবচেয়ে বেশি ৩৭ দশমিক ৯ শতাংশ রাজস্ব আহরণ করতে হবে। অর্থাৎ ভ্যাট থেকেই আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ ২৫ হাজার ১৬২ কোটি টাকা, যা চলতি সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৫ হাজার ৩১৬ কোটি টাকা বেশি। সে অনুযায়ী আগামী অর্থবছরে প্রতিদিন ভ্যাট সংগ্রহ করতে হবে ৩৪২ কোটি টাকা।
এছাড়া আগামী অর্থবছর প্রতিদিন আয়কর সংগ্রহ করতে হবে ২৮৪ কোটি টাকা। পুরো অর্থবছরে আয়কর থেকে সংগ্রহ করতে হবে ১ লাখ ৩ হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা। আর আগামী অর্থবছরে শুল্ক খাতে রাজস্ব আহরণ করতে হবে ৯৫ হাজার ৬৫২ কোটি টাকা। এই হিসাবে প্রতিদিন শুল্ক আহরণ করতে হবে ২৬২ কোটি টাকা। এরমধ্যে আগামী অর্থবছর সম্পূরক শুল্কের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫৭ হাজার ৮১৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রতিদিন সম্পূরক শুল্ক থেকে আয় করবে ১৫৮ কোটি টাকা। আর আমদানি শুল্কের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩৭ হাজার ৮০৭ কোটি টাকা। ফলে প্রতিদিন আমদানি শুল্ক থেকে আয় আসবে ১০৩ কোটি টাকা। এছাড়া রফতানি শুল্ক থেকে পুরো অর্থবছরে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫৫ কোটি টাকা। আবগারি শুল্কের লক্ষ্যমাত্রা ৩ হাজার ৬৮৬ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে এ খাতের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ হাজার ২২৯ কোটি টাকা। আর অন্যান্য কর বাবদ আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ১ হাজার ৫৩০ কোটি টাকা।
সরকারের বাজেটের তথ্যমতে, চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছর সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী প্রতি মাসে এনবিআরের আহরণ লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২৫ হাজার ৪১ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। মার্চ মাস পর্যন্ত প্রতি মাসে গড়ে আদায় হয়েছে ১৮ হাজার ৩৩৩ কোটি ৩৩ লাখ টাকার বেশি। এপ্রিল মাসে এই আদায় প্রায় অর্ধেক কমে এসেছে। এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, করোনাভাইরাস মহামারি ধাক্কার পর গত মাসে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা সংশোধন করে ২৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা কমিয়ে ৩ লাখ ৫০০ কোটি টাকা করা হয়। সেই সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে এপ্রিল মাস পর্যন্ত আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ লাখ ৩৫ হাজার ৭৯৬ কোটি টাকা। সেখানে আদায় করা সম্ভব হয়েছে ১ লাখ ৭৩ হাজার ৭৯৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা থেকেও ১০ মাসে প্রায় ৬২ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করা সম্ভব হয়নি।
করোনাভাইরাসের প্রভাব অব্যাহত থাকলে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হবে না বলে মনে করেন খোদ এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম। শুধু তা-ই নয়, স্বাধীনতার পর থেকে প্রতিবছরই রাজস্ব আয় বাড়লেও এবারই আগের অর্থবছরের তুলনায় রাজস্ব আয় কমতে যাচ্ছে বলে এনবিআর চেয়ারম্যান গত ১৪ মে অর্থ সচিবকে চিঠি দিয়ে এই তথ্য জানান।