মৌলভীবাজার প্রতিনিধি :
বাহারী নামের জলাশয়ে বাহারী রকমের মাছ। হাকালুকি, টাঙ্গুয়া, কুশিয়ারা নদী, হাইল হাওর, কাউয়াদীঘি হাওর, বড় হাওরের সঙ্গে সুরমা আর মনু নদী। তাদের বুক থেকে উঠে আসা বোয়াল, আইড়, বাঘাইড়, চিতল, কাতলা, বাউশ, কালাবাউশ, রুই; ছোট-মঝারি-বড় আরও কত্তো আকারের কত্তো রকমের মাছ! দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। যেন রূপোর পসরা সাজিয়ে বসেছেন সবাই।
মৌলভীবাজারের শেরপুরে কুশিয়ারা নদীর পাড়ে বিভিন্ন ধরনের মাছের সমারোহ নিয়ে শুরু হয়েছে প্রায় ২০০ বছরের ঐতিহ্যবাহি মাছের মেলা। সিলেট অঞ্চলের প্রাকৃতিক জলাশয়ের মাছ নিয়ে আসতে শুরু করেছেন মৎস্য ব্যবসায়ীরা।
মৌলভীবাজার, সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে হাওর, নদী, বিলসহ নানা জলাশয়ের মাছ নিয়ে এ মেলায় আসেন ব্যবসায়ীরা।
বিভিন্ন জাতের মাছের মধ্যে কোনোটার আকার ১৫ কেজি, কোনোটা ৮ কেজি। আবার কোনোটা ৫০ কেজি ছাড়িয়ে গেছে। প্রথম মাছ আসছে আড়তে। পরে সেখান থেকে খুচরা বিক্রিতে সরসরি ক্রেতার কাছে। যেন মাছের মেলা, সমারোহ। বৃহৎ সিলেট অঞ্চলের প্রাকৃতিক জলাশয়ের সু-স্বাদু মাছ।
বৈদ্যুতিক বাতি আর কুপির আলোয় ঝলমলে বড় বড় রুই-কাতলা আর চিতল-বোয়ালের রুপালি শরীর। পাইকার আর খুচরা ক্রেতা-বিক্রেতার হাঁকডাকে শীতের রাতে সরগরম হয়ে উঠেছে কুশিয়ারার পাড়।এর টানে মাছের মেলায় জড়ো হন দেশ-বিদেশের লাখো মানুষ। এটাই এখানকার দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য।
শেরপুর মাছের মেলা ঘুরে স্থানীয় মানুষের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, প্রায় ২ শত বছরের ঐতিহ্য অনুযায়ী প্রতি বাংলা সনের পৌষ মাসের শেষ দিনে শেরপুরের কুশিয়ারা নদীর পাড়ে আয়োজন করা হয় মাছের মেলা।
এখানে রাত গভীর হলেই শুরু হয় বেচাকেনা। দূর-দূরান্ত থেকে মাছ নিয়ে যেমন বিক্রেতারা আসেন, তেমনি আসেন পাইকার ও ক্রেতারা। একসঙ্গে বড় আকারের বিভিন্ন জাতের এত মাছ দেখার সুযোগ হাতছাড়া না করতে আসেন অনেক দর্শনার্থী। তাঁরা ঘুরে ঘুরে মাছ দেখেন, মূল্য নাগালে পেলে কিনেও নেন মাছ।
পাইকারী মাছ ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান বলেন, মাছের মেলা এ অঞ্চলের একটি ঐতিহ্য। মেলাকে কেন্দ্র করে এলাকাটি উৎসবমুখর হয়ে ওঠে। বৃহত্তর সিলেটের মধ্যে মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জের বিভিন্ন হাওর-নদীর মাছ ছাড়াও খুলনা, সাতক্ষীরা, যশোর, রাজশাহী, ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন স্থানের মাছ আসে।
স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল মতিন বলেন, এটা সৌখিন মানুষের মেলা। হাজার টাকার নীচে কোন মাছ পাওয়া যায় না। বড় ব্যবসায়ীরা সপ্তাহ খানেক পূর্বে বড় বড় মাছ সংগ্রহ করতে থাকেন। মেলায় ছোট আকারের মাছের দাম হাকানো হয় ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা, মাঝারি সাইজের মাছের দাম হাঁকানো হয় ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা এবং বড় সাইজের মাছের দাম ৫০ হাজার থেকে ২ লাখ টাকাও হাঁকানো হয়। এক রাতেই মাছের মেলায় কোটি টাকার মাছ বিক্রি হয়।
সিলেট থেকে এসেছেন প্রবাসি আমিরুল ইসলাম। ১২ হাজার টাকায় কিনেছেন একটি চিতল মাছ। মৌলভীবাজারের আরেক ক্রেতা সাদিকুর রহমান ২৫ হাজার টাকায় কিনেছেন এ অঞ্চলের বিখ্যাত আইড় মাছ। সাদিকুর রহমান বলেন, দাম বিষয় নয়, শখটাই বড়। পুরো বছর এদিনটার জন্য অপেক্ষা করি। আরেক ক্রেতা আব্দুল হাকিম বলেন, আজকালকার ছেলেমেয়েরা মাছ চেনেনা। তাদের মাছ চেনাতেই বাজারে নিয়ে এসেছি।
বিক্রেতা উমেদ মিয়া বলেন, লাখ টাকার মাছ নিয়ে এসেছি। আশা করছি ভালো বিক্রি হবে।
কুশিয়ারা নদীর প্রসিদ্ধ চিতল মাছ মেলায় তুলেছেন শামছুল ইসলাম। প্রায় ২০ কেজি ওজনের চিতল মাছটি ৩২ হাজার টাকা দাম হাঁকছেন তিনি। হাকালুকি হাওর থেকে বিশাল আকারের ১ জোড়া কাতল ও ১ জোড়া বোয়াল নিয়ে এসেছেন হিরা মিয়া ও লাল মিয়া। কাতলের জোড়ার দাম হাঁকছেন ২৬ হাজার এবং বোয়ালের জোড়ার দাম হাঁকছেন ৪৮ হাজার টাকা। তার পরও ক্রেতার অভাব হয় না। এমন দামেও বিক্রি হয় এ মাছ।
বিভিন্ন সময় মনুরমুখ, পারকুল, শেরপুর বাজারে মেলার স্থান বদল হলেও কখনও বন্ধ হয়নি। প্রতি বছর নিয়ম করেই বসে মাছের মেলা। তাদের দাবি অনুযায়ি দেশের সবচেয়ে বড় মাছের মেলা এটি। এ মেলাকে ঘিরে প্রতি বছর এলাকায় আলাদা একটা উৎসবের সৃষ্টি হয়। অনেকে আবার নাইয়োর আসেন এ মেলাকে কেন্দ্র করে।
সান নিউজ/সালি