নিজস্ব প্রতিবেদক: ইউরেশীয় অর্থনৈতিক ইউনিয়নের (ইইইউ) কাছে মুক্তবাণিজ্য চুক্তির (এফটিএ) জন্য আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব পাঠিয়েছে বাংলাদেশ। এ প্রস্তাব গৃহীত হলে রাশিয়াসহ জোটভুক্ত পাঁচ দেশে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা পাওয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ইইইউ’র অর্থনৈতিক ও নীতিনির্ধারণী কর্তৃপক্ষ ইউরেশীয় অর্থনৈতিক কমিশনের (ইইসি) কাছ থেকে সবুজ সংকেত পাওয়ার পরে বাংলাদেশ গত সপ্তাহে এ প্রস্তাব দিয়েছে বলে জানা গেছে।
চুক্তির জন্য বাংলাদেশকে এবার জোটের সদস্যদের অর্থাৎ রাশিয়া, বেলারুশ, কাজাখস্তান, আর্মেনিয়া ও কিরগিজস্তানের সম্মতি পেতে হবে। এ পাঁচটি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ১৫০ কোটি ডলারের বেশি। মুক্তবাণিজ্য চুক্তি হলে এর পরিমাণ আরও কয়েকগুণ বাড়বে বলে আশা করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য এগিয়ে নিতে ২০১৯ সালের মে মাসে বাংলাদেশ ও ইইইউ’র মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হয়। পরে ১৯টি খাত চিহ্নিত করে সেগুলোতে বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়ানোর লক্ষ্যে একটি ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা হয়। নভেম্বরে ওয়ার্কিং গ্রুপের প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় মস্কোয়। এতে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এফটিএ অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব নূর মো. মাহবুবুল হক এবং ইইসি’র নেতৃত্বে ছিলেন এর বোর্ড সদস্য সের্গেই গ্লাজিয়েভ। বৈঠকে বাংলাদেশ পক্ষ ইইইউর সঙ্গে মুক্ত বণিজ্য চুক্তির আগ্রহ দেখালে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব পাঠানোর পরামর্শ দেয় ইইসি।
এ বিষয়ে নূর মো. মাহবুবুল হক বলেন, ইইইউ’র সঙ্গে আমরা একটি অর্থনৈতিক সহযোগিতার কথা অনেকদিন ধরেই বলছিলাম। কারণ, ওই অঞ্চল আমাদের জন্য একটি বড় বাজার। ২০১৯ সালে সমঝোতা স্মারক সই হয়েছিল। এখন আমরা মুক্তবাণিজ্য চুক্তির জন্য তাদের কাছে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব পাঠিয়েছি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে এই প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। সেটি পাওয়ার পর তারা যোগাযোগ করবে। তারপর ‘নেগোসিয়েশন’ শুরু হবে, সেজন্য অনেক সময় লাগে।
তিনি আরও বলেন, চুক্তিতে বলা হয়েছে, আমরা ১৯টি খাতে সহযোগিতা করবো। কিন্তু সবগুলো একসঙ্গে কার্যকর করা কঠিন। এ কারণে প্রথম ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকে আমাদের পক্ষ থেকে বলেছি, প্রাথমিকভাবে পণ্য বাণিজ্য, সেবা বাণিজ্য, বিনিয়োগসহ অন্য বিষয়গুলোতে নজর দিতে হবে। তাদের যে পদ্ধতি, প্রথম এমওইউ করে তারপর মুক্তবাণিজ্য চুক্তি সইয়ের পর পরবর্তী ধাপে যাবে।
বাংলাদেশ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা রুশ সংবাদমাধ্যম রাশিয়া-ব্রিফিংকে বলেছেন, আমাদের প্রধান লক্ষ্য রাশিয়ার বাজার। কিন্তু তারা এককভাবে কোনো চুক্তি করতে না চাওয়ায় আমাদের ইইইউ’র মাধ্যমে ওই সুবিধা আদায় করতে হচ্ছে। বাংলাদেশ এরই মধ্যে সম্ভাব্যতা যাচাই করেছে এবং দেখা গেছে, ইউরেশিয়ার সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি ইতিবাচক ফল দেবে।
ইউরেশিয়ার দেশগুলোতে, বিশেষ করে রাশিয়ার বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক, পাট ও পাটজাত পণ্য, হিমায়িত মাছ, ওষুধ, আলু ও সবজি রপ্তানির ভালো সম্ভাবনা রয়েছে। বর্তমানে রাশিয়ায় তৈরি পোশাক, পাট, হিমায়িত চিংড়ি, আলুসহ নানা ধরনের পণ্য রপ্তানি হলেও তার পরিমাণ খুব বেশি নয়। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশ ইইইউ সদস্য দেশগুলোতে ৩৯ কোটি ৮০ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। একই সময়ে তাদের কাছ থেকে আমদানি ছিল অন্তত ১১০ কোটি ডলারের।
চুক্তি হলে কী পাবে ইইইউ
বাংলাদেশের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি ইউরেশীয় জোটের পাঁচ সদস্যের জন্যই লাভজনক হবে। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা সার্কের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। এই জোটে আরও রয়েছে ভারত, পাকিস্তান, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান ও আফগানিস্তান। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে মুক্তবণিজ্য চুক্তি থাকলে এ দেশে কারখানা স্থাপন করে পার্শ্ববর্তী বাজারগুলো ধরার সুযোগ বাড়বে ইইইউভুক্ত দেশগুলোর।
এছাড়া বাংলাদেশ বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টিসেক্টরাল, টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কোঅপারেশন বা বিমসটেকেরও সদস্য। এই জোটে আরও রয়েছে ভারত, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড। সার্ক জোটের মোট জিডিপি ৩ লাখ ৬৭ হাজার কোটি ডলার এবং বিশ্বের ২১ শতাংশ মানুষের বসবাস এর আটটি দেশে। বিপরীতে, বিমসটেকের জিডিপি প্রায় ২ লাখ ৭ হাজার কোটি ডলার এবং জনসংখ্যা বিশ্বের ২২ শতাংশের মতো।
২০২৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে (এলডিসি) উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি পেতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এর ফলে এলডিসি হিসেবে পশ্চিমা দেশগুলো থেকে পাওয়া জিএসপির মতো বেশ কিছু সুবিধা আর থাকবে না। এ জন্যই সম্ভাব্য বাণিজ্য অংশীদারদের সঙ্গে নতুন মুক্ত অথবা অগ্রাধিকার বাণিজ্য চুক্তি করতে জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে বাংলাদেশ।
২০২০ সালের ডিসেম্বরে ভুটানের সঙ্গে প্রথম দ্বিপাক্ষিক অগ্রাধিকার বাণিজ্য চুক্তি (পিটিএ) করে বাংলাদেশ। এছাড়া ভারত, শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তির আলোচনা চলছে।
সাননিউজ/এএএ