নিজস্ব প্রতিবেদক:
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমকে নিয়ে জাতীয় সংসদে আনা শোক প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে আবেগ আপ্লুত হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় তিনি শনিবার (১৩ জুন) মারা যাওয়া ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ আব্দুল্লাহকে নিয়েও কথা বলতে গিয়ে আপ্লুত হয়ে পড়েন।
একই দিনে এমন দুই নেতাকে হারানো খুবই কষ্টকর বলেও তিনি উল্লেখ করেন। আপ্লুত শেখ হাসিনা বক্তব্য দিতে গিয়ে একপর্যায়ে থেমেও যান। এ সময় প্রধানমন্ত্রীকে চোখ মুছতে দেখা গেছে।
তিনি বলেন, ‘আমার খুব কষ্ট হচ্ছে বলতে। অনেক কষ্ট বুকে নিয়ে আজ এখানে দাঁড়াতে হচ্ছে। এভাবে সবাইকে হারানো খুবই দুঃখজনক।’
রবিবার (১৪ জুন) জাতীয় সংসদে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর আনা শোক প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় অংশ নেন প্রধানমন্ত্রী। এছাড়া, জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগের আরও কয়েকজন সংসদ সদস্য আলোচনায় অংশ নেন। পরে শোক প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণ করা হয়।
আলোচনাকালে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘গত ১০ তারিখে সংসদে শোক প্রস্তাব নিতে হলো। মাত্র কয়েকটা দিন গেলো, এরইমধ্যে আমরা হারালাম পার্লামেন্টের একজন বিশিষ্ট সদস্য মোহাম্মদ নাসিমকে। সকাল বেলা তার মৃত্যুর খবর আর রাতে শেখ মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ। একই দিনে দুটি মৃত্যু, এটা আমাদের জন্য কষ্টকর। বারবার পার্লামেন্টে আমাদের শোক প্রস্তাব নিতে হচ্ছে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মোহাম্মদ নাসিম ও শেখ মোহাম্মদ আব্দুল্লাহর শোকসন্তপ্ত পরিবারকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আমাদের ধৈর্য ধরতে হবে। স্বজন হারানোর বেদনা কী সেটা আমি জানি। সবাইকে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ধৈর্য দিন, যারা চলে গেছেন তাদের বেহেশত নসিব করুন সেই কামনা করি।’
মোহাম্মদ নাসিমকে নিয়ে আলোচনাকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার পিতা জাতীয় চার নেতার অন্যতম শহীদ মনসুর আলীর প্রসঙ্গ তোলেন।
তাদের পরিবারের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের পারিবারিক আসা-যাওয়ার সম্পর্ক ছিল উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেন, ‘‘পঁচাত্তরে জাতির পিতাকে হত্যার পর খন্দকার মোশতাক মনসুর আলী সাহেবকে ডেকে নিয়ে মন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বলেছিলেন, ‘তোমার হাতে বঙ্গবন্ধুর রক্ত, তুমি ভাবলা কী করে তোমার কেবিনেটে আমি আসবো। এটা কখনোই আমার কাছ থেকে যোগ্য নয়।’ তারপর তাকে কারাগারে প্রেরণ করা হয়।’’
নাসিমকে স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘মোহাম্মদ নাসিম রাজনৈতিক নেতা হিসেবে অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন। ১৯৮১ সালে আমি যখন দেশে ফিরে আসি, তখন আমার একটা প্রচেষ্টা ছিল শহীদ পরিবারের যারা ছিল, তাদের একসঙ্গে করে নিয়ে আসা। আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করা এবং আরও শক্তিশালী করে গড়ে তোলা। সেই কাজটি করতে গিয়ে সবসময় নাসিম ভাইকে পাশে পেয়েছি। নাসিম ভাই অত্যন্ত সাহসী ছিলেন। তিনি যেকোনও অবস্থা মোকাবিলা করতে যেতেন। আর এটা করতে গিয়ে বারবার তার ওপর হামলা হয়।’
তিনি বলেন, ‘আজকে বাংলাদেশে একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ আছে, অর্থনৈতিক উন্নতির দিকে আমরা এগিয়ে যাচ্ছিলাম। জাতির পিতার নেতৃত্বে দেশটা আমরা স্বাধীন করেছিলাম— এই আশা নিয়েই তো বেশি মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন হবে, আর একটা সুন্দর জীবন পাবে, একটা শান্তিপূর্ণ পরিবেশ পাবে। অর্থনৈতিক উন্নতি হবে। দেশ এগিয়ে যাবে। সেই আদর্শ তা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বারবার এই আঘাত পেতে হয়েছে।’
ধর্ম প্রতিমন্ত্রীকে স্মরণ করে সরকার প্রধান বলেন, ‘আমি দেশে আসার পর থেকে আব্দুল্লাহ সাহেবকে পেয়েছি। তিনি মনি ভাইয়ের সঙ্গে ছিলেন। নির্বাচন পরিচালনাই নয়, নির্বাচনি এলাকার সবকিছু তার দেখাশোনা করতে হতো। রাজনীতিতে গোপালগঞ্জবাসী কঠিন সময়ের মুখোমুখি হয়েছেন। জিয়াউর রহমান, এরশাদ, খালেদা জিয়া যখন যে ক্ষমতায় এসেছে, তাদের জন্য একটি লক্ষ্যই ছিল গোপালগঞ্জের ওপর হাত দেওয়া। আমাদের বহু নেতাকর্মী নির্যাতিত হয়েছে। সে সময়গুলোতে সংগঠনকে ধরে রাখা, নেতাকর্মীদের দিকে নজর দেওয়া— এই কাজগুলো অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে আব্দুল্লাহ সাহেব করে গেছেন। আমি সরকার বা বিরোধী দল যেখানেই থাকি না কেন, আমার নির্বাচনি এলাকা আব্দুল্লাহ সাহেব দেখতেন। তার মৃত্যু আমাদের জন্য বিরাট ক্ষতি।’
তিনি জানান, কওমি মাদ্রাসা কয়েকটি ভাগে বিভক্ত ছিল। সেগুলোকে এক করে তাদের একটি সনদ দেওয়া। নীতিমালা ও আইন— সেই আইন পাস করার জন্য আমি আব্দুল্লাহ সাহেব ও আমার মিলিটারি সেক্রেটারি জয়নাল আবেদিন সাহেবকে দায়িত্ব দিয়েছিলাম। তারা দুজনই ঠান্ডামাথার লোক, সুন্দরভাবে কাজটি করেছেন। আজ সেই দুজনই নেই। রাত ১০টার দিকে আমি খবর পেলাম, আর হাসপাতালে নিতে নিতেই ১১টার দিকে মৃত্যুর খবর পেলাম।’
এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমরা আন্দোলন সংগ্রামের সময় অনেক দল নিয়ে সব সময় সংগঠিত হয়েছি। ঐক্য গড়ে তোলার চেষ্টায়— এই ঐক্যের দায়িত্বটা আমি সবসময় নাসিম সাহেবকে দিতাম। অন্যান্য দলের সঙ্গে চমৎকার সম্পর্ক নিয়ে চলার দক্ষতা তার ছিল এবং তিনি তা পছন্দ করতেন। একটা পাশ প্যারালাইজড হয়ে যাওয়ার পরেও কখনও থেমে থাকেননি। ঐক্য জোটের শরিকরাও তাকে খুব পছন্দ করতেন। তার চলে যাওয়াটা আমাদের আওয়ামী লীগের জন্য বিরাট ক্ষতি, এটা নিয়ে সন্দেহ নেই।’
দেশে ফেরার পর শেখ হাসিনাকে রাজনীতিতে অনেক বাধা অতিক্রম করতে হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘তখন চলার পথ এত সহজ ছিল না। বারবার বাধা। যে ক’টা মানুষ সবসময় আমার পাশে থেকেছেন, প্রতিটি ক্ষেত্রে সমর্থন দিয়েছেন, তাদের দুজন মানুষকে একই দিনে হারালাম— এটা সবচেয়ে কষ্ট।’
সান নিউজ/ আরএইচ