ফারুক আহমাদ আরিফ
দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে পঙ্গপালের গতিতে। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষিত বেকারত্বের কারণে পারিবারিক সুখ-সম্প্রীতি বিনষ্ট হচ্ছে। সামাজিক মর্মপীড়ায় অসংখ্য তরুণ দিশেহারা। এ অবস্থায় রাষ্ট্রীয় বেড়াজালে ছাড় করাতে পারছে না দাতা গোষ্ঠীদের প্রতিশ্রুত বিপুল পরিমাণ অর্থও। এসব অর্থে উল্লিখিত প্রকল্পের মতো লাখো মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব।
চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) পরিচালিত এক জরিপে বলা হয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলো থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের ৬৬ শতাংশ অর্থাৎ দুই-তৃতীয়াংশই বেকার।
২০১৯ সালে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ‘এশিয়া-প্যাসিফিক এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল আউটলুক-২০১৮’ শীর্ষক এক প্রতিবেদন জানায়, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ২৮ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ উচ্চশিক্ষায় বেকারত্বের হারে দ্বিতীয়। এ হার ১০ দশমিক ৭ শতাংশ। প্রতিবেদনে ২০০০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত এই অঞ্চলের ২৮ দেশের বেকারত্ব, তরুণদের কর্মসংস্থান, নিষ্ক্রিয় তরুণের হার, আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক কর্মসংস্থান, কর্মসন্তুষ্টি ইত্যাদির তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা হয়।
অথচ অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের বার্ষিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সদ্য-সমাপ্ত ২০২০-২১ অর্থবছরে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলোর প্রতিশ্রুতি ছিলো প্রায় ৯৩৫ কোটি ডলার সহায়তার। টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ ৭৯ হাজার ৪৭৫ কোটি টাকা। সেখানে ছাড় হয়েছে ৭১০ কোটি ডলার বা ৬০ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা। আর বাকি প্রতিশ্রুতির ২২৫ কোটি ডলার বা ১৯ হাজার ১২৫ কোটি টাকা ছাড় হয়নি। একইভাবে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৯৫৫ কোটি ৪৪ লাখ ডলারের বিপরীতে ছাড় হয়েছিলো ৭২৭ কোটি ১৯ লাখ ডলার বা ৬১ হাজার ৮১১ কোটি ১৫ লাখ টাকা। অর্থাৎ ওই অর্থ বছরেও ছাড় হয়নি ২২৮ কোটি ২৫ লাখ ডলার বা ১৯ হাজার ৪০১ কোটি টাকা। দুই অর্থবছরে সর্বমোট ৩ লাখ ৮ হাজার ৫২৬ কোটি টাকা ছাড় করানোই সম্ভব হয়নি। অথচ এসব টাকা দিয়ে অর্ধকোটি বেকারের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা সম্ভব হতো।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০১৯ সালে স্নাতক পাস করা শিক্ষার্থী মো. ফজলুল হক পাভেল বলেন, সরকারি বা বেসরকারি সেক্টরে চাকরি পাচ্ছি না। এক্ষেত্রে সরকার সুদমুক্ত ঋণ দিয়ে এগিয়ে আসতে পারে। পর্যায়ক্রমে তা পরিশোধ করা হবে। কেননা আমাদের চিন্তা থাকলেও আর্থিক সামর্থ্য না থাকায় কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান করা সম্ভব হচ্ছে না।
স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের রেবন নামের এক স্নাতক পাস করা শিক্ষার্থী বলেন, বেকারত্ব সমস্যার সমাধান সরকারের একার পক্ষে যেহেতু সম্ভব হচ্ছে না সেক্ষেত্রে দাতাসংস্থাগুলোর কাছ থেকে ঋণ নিতে পারে। এসব প্রতিষ্ঠান দেশের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্ম-কাণ্ডে ঋণ দিচ্ছে। তারা যদি কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সহযোগিতা করে তবে বেকারত্ব সমস্যা অনেকটাই হ্রাস পাবে। এতে বেকারত্ব দূরীকরণের পাশাপাশি দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
মুভমেন্ট ফর ওয়ার্ল্ড এডুকেশন রাইটসের পক্ষ থেকে ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে কোটি মানুষের কর্মসংস্থানের দাবি জানানো হয়েছিলো ২০১৮ সালে। সে বিষয়ে সংগঠনটির যুগ্ম-আহ্বায়ক এনায়েতুল্লাহ কৌশিক বলেন, মাত্র ৫ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকায় এক কোটি ১০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব।
তিনি বলেন, মাস্টার্স পাস করা ৫ লাখ শিক্ষার্থীকে ৯ লাখ করে ৪৫ হাজার কোটি, অনার্স পাস ২৫ লাখকে ৭ লাখ করে ১ লাখ ৭৫ হাজার কোটি, এইচএসসি পাস ৩০ লাখকে ৫ লাখ করে ১ লাখ ৫০ হাজার কোটি ও এসএসসির ৫০ লাখকে ৩ লাখ টাকা করে ঋণ দিলে এই অর্থের প্রয়োজন। এদেরকে ৬ বছরের জন্য ঋণ দেবে তার মধ্যে দ্বিতীয় বছর থেকে পরিশোধ শুরু হবে। পরিশোধে প্রথম শ্রেণি ৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা দিবে তাতে করে প্রতিমাসে তাকে ১৫ হাজার ৮৩৩ টাকা, দ্বিতীয় শ্রেণি ৭ লাখ ৪০ হাজার টাকা দেবে, তাতে করে তাকে ১২ হাজার ৩৩৩ টাকা, তৃতীয় শ্রেণি ৫ লাখ ৩০ হাজার টাকা দেবে, তাতে তার প্রতিমাসে ৮ হাজার ৮৩৩ টাকা, চতুর্থ শ্রেণি ৩ লাখ ২০ হাজার টাকা দেবে, তাতে করে তাকে ৫ হাজার ৩৩৩ টাকা প্রতিমাসে পরিশোধ করতে হবে। এভাবে ৫ বছর অর্থায়ন করলে দেশে শিক্ষিত ও ঝরেপড়া শিক্ষিতদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব।
কৌশিক বলেন, সরকার করোনাকালে যে প্রণোদনা দিয়েছিলো সে আঙ্গিকে ব্যাংকের মাধ্যমে এসব টাকা ঋণ দিতে পারে। এক্ষেত্রে মর্গেজ হিসেবে সার্টিফিকেট, পারিবারিক কাগজপত্র জমা রাখতে পারে। এসব টাকা দিয়ে পর্যায়ক্রমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে বেকারত্ব দূর করা যায়। এখন তো অনেক কর্মসূচি চালু আছে সেগুলো যথাযথভাবে দেয়া হয় না। কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে না পারলে বেকারের সংখ্যা আরও বাড়বে। এতে রাষ্ট্রীয় মেধা-শ্রমের ক্ষতি হচ্ছে। অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পাবে। সেক্ষেত্রে সরকার উল্লিখিতদের ঋণ দিতে পারে।
বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন সান নিউজকে বলেন, দাতাগোষ্ঠীগুলোর অর্থ ছাড়ের অনেক কারণ থাকে। তার মধ্যে সময়মতো প্রকল্প শুরু ও শেষ করা অন্যতম। কাজ করে তাদের বিল দেয়ার পরেই সাধারণত অর্থ ছাড় দেয়। আমরা এই জায়গায় পিছিয়ে পড়ি।
তিনি বলেন, সে ক্ষেত্রে দিন দিন অর্থ ছাড় না হওয়ার বিষয়টি বৃদ্ধি পাচ্ছে।
গত দুই অর্থবছরের প্রতিশ্রুত ছাড় না হওয়া ৩ লাখ ৮ হাজার ৫২৬ কোটি টাকায় অর্ধ কোটি তরুণের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব হতো এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সরকার অনেক প্রকল্প নিচ্ছে। বেকারত্ব দূর করতে হলে প্রকৃত লোকটিকে খোঁজে বের করতে হবে। প্রতিটি ঋণদানে আগে তার পরিকল্পনাটি যথাযথভাবে মূল্যায়ন করে তাকে ঋণ দিলে বেকারত্ব দূর করা সম্ভব।
তিনি বলেন, যে টাকা ছাড় হয়নি তাতো বেকারত্ব দূর করার কোন প্রকল্প নয় তবে এই পরিমাণ টাকায় এতো মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি সম্ভব।
ড. জাহিদ হোসেন বলেন, সরকার অনেক প্রকল্প নেয়। সেগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হওয়া দরকার। প্রকৃত উদ্যোক্তা চিহ্নিত করে ঋণ দিতে হবে।
অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম সান নিউজের প্রশ্নের জবাবে বলেন, প্রতিবছরই দাতাগোষ্ঠীদের প্রতিশ্রুত অর্থের বিশাল একটা অংশ ছাড় করানো সম্ভব হয় না। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, আমাদের প্রশাসনের দুর্বলতার ফলেই এটি হয়ে থাকে।
কেননা যে প্রকল্প নেয়া হয় তা সময়মতো বাস্তবায়ন করা হয় না। সেক্ষেত্রে দাতারা তাদের প্রতিশ্রুতির অর্থগুলোও পুরোপুরি ছাড় দেন না।
প্রবীণ এই অর্থনীতিবিদ বলেন, শুধুমাত্র বেকারত্ব দূর করার জন্য বিশেষ প্রকল্প নিতে পারে সরকার। সেখানে দাতাগোষ্ঠীগুলোকে সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন। আর প্রকল্প বাস্তবায়নে কোনো ধরণের ছাড় নয়। এ জন্য প্রশাসনের দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হবে।
তিনি বলেন, কাজের মাধ্যমেই বেকারত্ব দূর করতে হবে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি না করলে বেকারত্ব তো থেকেই যাবে। দাতাগোষ্ঠীগুলো তো বেসরকারি খাতে ঋণ দেবে না। সে ক্ষেত্রে সরকারিভাবেই প্রকল্প নিতে হবে।
সান নিউজ/এফএআর