সান নিউজ ডেস্ক: বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল প্রয়াত মাহবুবে আলমের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে আবেগঘন স্ট্যাটাস দিয়েছেন তার ছেলে সাংবাদিক সুমন মাহবুব।
সোমবার (২৭ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় সুমন মাহবুব তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেন, ‘আজ ২৭ সেপ্টেম্বর। ঠিক এক বছর আগে এ দিন সন্ধ্যা ৭টা ২৫ মিনিটে আমার বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। হঠাৎ মাথার ওপর থেকে একটা ছায়া সরে গেল। বাস্তবতার প্রখর তাপের অনুভূতি পেতে শুরু করলাম। গত বছর ৪ সেপ্টেম্বর করোনায় আক্রান্ত হয়ে আমার বাবা ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ভর্তি হন।
১৭ সেপ্টেম্বর দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। বাবা একেবারেই সুস্থ। দুপুরে পেট ভরে খেলেন। সকাল আর দুপুরে বেশ হাঁটলেন। চিকিৎসকরা এসে দেখে বললেন, দুই এক দিনের মধ্যে বাবাকে ডিসচার্জ করা যাবে। সন্ধ্যায় বাবার জুনিয়র শাখাওয়াত আসলেন। ঘটনাচক্রে আমরা দুজনেই একই বছর নটরডেম কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেছি। শাখাওয়াত আসার পর আমি সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে বাসায় ফিরলাম।
বাবা স্বাস্থ্য নিয়ে খুবই সচেতন ছিলেন। কিন্তু তার একটা ছোট ভুল সব এলোমেলো করে দিল। এট্রিয়াল ফিব্রিয়ালেইশনের (অস্বাভাবিক দ্রুত হৃদস্পন্দন) সমস্যা ছিল বাবার। হাসপাতালে ভর্তির সময় বিষয়টি চিকিৎসককে জানাননি তিনি। তাই চিকিৎসকও এ রোগের কোনো ওষুধ দেননি। যাই হোক; ১৮ সেপ্টেম্বর ভোরে আমার কাছে ফোন আসল। বাবার শরীর খারাপ করেছে। আমি যেন দ্রুত সিএমএইচে যাই। আমি মনে হয়; ১২ থেকে ১৩ মিনিটের মধ্যে সিএমএইচে পৌঁছলাম। পৌঁছে দেখলাম, বাবা যে কক্ষে রয়েছেন সেখানে চিকিৎসকদের জটলা।
আব্বু আমার দিকে আড় চোখে তাকিয়ে বললেন, ‘আমার বুকটা গরমে পুড়ে যাচ্ছে। ঠান্ডা কিছু ধরো আমার বুকের উপরে।’
আমি কয়েকটা কাগজের ন্যাপকিন এক সঙ্গে নিয়ে ভাঁজ করে আব্বুর বুকের উপর ধরলাম। বলল, ‘এটা দিয়ে কিচ্ছু হবে না।’
তখন কে যেন আব্বুর একটা গেঞ্জি ভিজিয়ে এনে বুকের মধ্যে চেপে ধরল। ওই অবস্থায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো, আব্বুকে আইসিইউতে স্থানান্তর করা হবে। এরমধ্যেই সিএমএইচের তৎকালীন কমান্ড্যান্ট আমাকে বললেন, ‘স্যারের যে এট্রিয়াল ফিব্রিয়ালেইশন ছিল; সেটা তোমরা জানতে না ?’ আমি বোকার মতো ওনার দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
আব্বুকে যখন আইসিইউতে নেওয়ার জন্য অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হচ্ছিল; তখন আব্বু বেশ কয়েকবার বলল, ‘সুমন কই ?’ কে যেন জানতে চাইলো, ‘সুমন কে ?’ আব্বু বলল, ‘আমার ছেলে।’ আমি আব্বুর সামনে গেলাম। আমাকে দেখল। কিছু বলল না।
এরপর, আব্বুকে আইসিইউতে নেওয়া হলো। ২৩ সেপ্টেম্বর আব্বুর শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি হলো। আব্বুকে ভেন্টিলেশন দেওয়া হলো। সবাই আশার কথা বলে। আমরাও আশায় বুক বাঁধি। আব্বু সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরবে। আমার বোন প্রতিদিন আইসিইউতে গিয়ে বাবার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে দোয়া পড়ে।
আমি সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সিএমএইচের করিডোরগুলোয় পায়চারি করি। বাবার বিছানার পেছনে যে জানলাটা ছিল; ওটার দিকে তাকিয়ে থাকি। স্যালাইনের স্ট্যান্ডটা দেখা যেত। ওটার দিকে তাকিয়ে থেকে বোঝার চেষ্টা করি, কতগুলো স্যালাইন ঝুলছে। স্যালাইনের সংখ্যা কম হলে; মনে হয়, আব্বু সুস্থ হয়ে উঠছে।
২৭ সেপ্টেম্বর সকালে সিএমএইচের কমান্ড্যান্ট আমাকে ফোন করে জানতে চাইলেন, আমি কোথায়। এরপর উনি এসে আমার সঙ্গে দেখা করে জানালেন, ভোরে বাবার একটা হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। তার অবস্থা স্থিতিশীল নয়। এরপর বেশ কয়েকবার উনি আমার সঙ্গে দেখা করে বিভিন্নভাবে আব্বুর অবস্থা বোঝানোর চেষ্টা করলেন।
এর মধ্যে, আমার বোন আসলো। আমি তাকে কিছু বলার সাহস পাইনি। আমি তখনো সবাইকে বলছি, সব ঠিক হয়ে যাবে। আইসিইউ থেকে বের হয়ে শিশির কণা আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। ও বললো, ‘দাদা, বাবার চোখ যেন কেমন হয়ে আছে। চোখের কোনায় পানি জমে আছে। তুমি গিয়ে ওদের কিছু বলো।’ আমি তাকে গাড়িতে করে বাসায় পাঠিয়ে দিলাম।
এরমধ্যেই একজন ডাক্তার এসে আমার সামনে কেঁদে ফেললেন। শুধু বললেন, ‘সুমন ভাই, একটু শক্ত হন। আমি তো ভালো কিছু দেখছি না।’
৪টার পর থেকে আব্বুর বেশ কয়েকজন জুনিয়র আসলেন। এর আগেই আমি শাখাওয়াতকে ডেকে নিয়ে এসেছি।
বিকাল সাড়ে ৬টার দিকে আমাকে ফোন করে বলা হলো যে, আব্বুর অবস্থা আরও অবনতি হয়েছে। জবাবে আমি বললাম, যা দরকার পড়ে সব কিছুই করুন। ৭টার দিকে আমাকে আইসিইউতে ডেকে পাঠানো হলো। আমি আইসিইউর করিডোরে বসে আছি। সাড়ে ৭টার দিকে সিএমএইচের কমান্ড্যান্ট বের হয়ে এসে আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘সুমন আই এম সরি’।
আমি ধরা গলায় বললাম, ‘কখন?’ ওনার পেছন থেকে আইসিইউ ইনচার্জ বললেন, ‘৭টা ২৫ মিনিট।’
কিছুক্ষণ পর সাদা কাপড়ে ঢাকা আব্বুর নিথর দেহটা বের করা হলো আইসিইউ থেকে। মনে হচ্ছিল আব্বু গভীর ঘুমে অচেতন।’
সান নিউজ/এনএএম