নিজস্ব প্রতিবেদক: বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে অন্যতম ন্যাক্কারজনক ঘটনা হলো ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা। এই দিনে মুহুর্মুহু গ্রেনেডের বিকট বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে ঢাকার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ। ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসের সেই দিনটিও ছিল শনিবার। ১৭ বছর আগের রক্তাক্ত বিভীষিকাময় এদিনে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টায় গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছিল।
তবে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মানবঢাল তৈরি করে শেখ হাসিনাকে বাঁচাতে পাড়লেও মহিলা লীগের তৎকালীন সভাপতি আইভী রহমান, শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত দেহরক্ষী ল্যান্স করপোরাল (অব.) মাহবুবুর রহমানসহ ২৪ জন নেতাকর্মী এই ভয়াবহ ও নিষ্ঠুর-নির্মম গ্রেনেড হামলায় প্রাণ হারান। আহত হন শেখ হাসিনাসহ পাঁচ শতাধিক নেতা-কর্মী।
অনেকেই চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেছেন। কেউ কেউ আজও ফিরে পাননি স্বাভাবিক জীবন। গ্রেনেডের স্প্লিন্টারের দুর্বিষহ যন্ত্রণা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন মৃত্যুর দিকে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
২১ অগাস্ট হামলায় নিহত অন্যরা হলেন হাসিনা মমতাজ, রিজিয়া বেগম, রফিকুল ইসলাম (আদা চাচা), রতন শিকদার, মোহাম্মদ হানিফ ওরফে মুক্তিযোদ্ধা হানিফ, মোশতাক আহমেদ, লিটন মুনশি, আবদুল কুদ্দুছ পাটোয়ারী, বিল্লাল হোসেন, আব্বাছ উদ্দিন শিকদার, আতিক সরকার, মামুন মৃধা, নাসিরউদ্দিন, আবুল কাসেম, আবুল কালাম আজাদ, আবদুর রহিম, আমিনুল ইসলাম, জাহেদ আলী, মোতালেব ও সুফিয়া বেগম। একজনের পরিচয় এখনও জানা যায়নি।
আওয়ামী লীগের দাবি, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা ছিল ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের কালরাতের বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের ধারাবাহিকতা। আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করতে সংগঠনের সভাপতি শেখ হাসিনাসহ দলের প্রথম সারির নেতাদের হত্যার উদ্দেশ্যেই ওই ঘৃণ্য হামলা চালায় ঘাতক চক্র। প্রকাশ্য দিবালোকে রাজনৈতিক সমাবেশে এ ধরনের নারকীয় হত্যাযজ্ঞ পৃথিবীর ইতিহাসে দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া বিরল।
ভয়াবহ এই হামলার ঘটনার পরদিন মতিঝিল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) ফারুক আহমেদ বাদী হয়ে মামলা করেন। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের নেতারা তদন্তের শুরুতে এ হামলার জন্য আওয়ামী লীগকেই দায়ী করে বক্তব্য দিয়েছিলেন। প্রতিবেশী দেশের গোয়েন্দা সংস্থা ওই হামলায় জড়িত বলেও সে সময় প্রচার চালানো হয়েছিল। এমনকি ঘটনা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে জর্জ মিয়া নামের একজনকে ধরে এনে নাটক সাজায় তৎকালীন সরকার। তবে শেষ রক্ষা হয়নি।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৮ সালের ১১ জুন তদন্ত শেষে দেওয়া অভিযোগপত্রে বিএনপি নেতা আবদুস সালাম পিন্টু, তার ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন ও হুজি নেতা মুফতি আব্দুল হান্নানসহ ২২ জনকে আসামি করা হয়। তখন জানা যায়, শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে হামলার ছক করা হয়েছিল। পাকিস্তান থেকে এসেছিল হামলায় ব্যবহৃত আর্জেস গ্রেনেড।
পরে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পর অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন আদালত। দুই বছর তদন্তের পর ২০১১ সালের ৩ জুলাই তারেক রহমানসহ ৩০ জনকে আসামি করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। এর ফলে এ মামলায় মোট আসামির সংখ্যা হয় ৫২। তাদের মধ্যে আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও মুফতি হান্নান এবং তার সহযোগী শাহেদুল ইসলাম বিপুলের মৃত্যুদণ্ড অন্য মামলায় কার্যকর হয়। তিনজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ায় এ মামলার আসামির সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৯ জনে।
হামলার ১৪ বছর পর ২০১৮ সালের অক্টোবরে ঢাকার দ্রুত বিচার টাইব্যুনালের বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন এ মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক শিক্ষা উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থার (ডিজিএফআই) সাবেক পরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী ও জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুর রহিমসহ ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেন।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে ১৪ জন জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের (হুজি-বি) সদস্য। এ ছাড়া বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ১৯ জনের যাবজ্জীবন এবং অপর ১১ পুলিশ ও সেনা কর্মকর্তাকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দেওয়া হয়। রায় দেওয়ার সময় ৩১ জন কারাগারে ছিলেন। আর পলাতক ছিলেন বাকি ১৮ জন।
তারা হলেন, তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরী, কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ, এটিএম আমিন, সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দার, খান সাঈদ হাসান, ওবায়দুর রহমান, মুফতি শফিকুর রহমান, মুফতি আবদুল হাই, রাতুল বাবু, মোহাম্মদ হানিফ, আবদুল মালেক, শওকত ওসমান, মাওলানা তাজউদ্দিন, ইকবাল হোসেন, মাওলানা আবু বকর, খলিলুর রহমান ও জাহাঙ্গীর আলম।
এর মধ্যে গ্রেনেড হামালা মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডনে অবস্থান করছেন। মামলার অভিযোগপত্রে তাকে পলাতক হিসেবে দেখানো হয়েছে।
এছাড়া গ্রেনেড হামলা মামলার রায়ে মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত মাওলানা তাজউদ্দীন বিএনপি সরকারের শিক্ষা উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টুর ভাই। গ্রেনেড হামলার পর তাকে ভুয়া পাসপোর্টের মাধ্যমে বিদেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়। বর্তমানে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় আছেন বলে জানা যায়।
অপরদিকে মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত বিএনপি সরকারের সময় প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী ২০০৭ সালে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। বর্তমানে তাঁর অবস্থান সম্পর্কে কেউ নিশ্চিত নয়। তবে তিনি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ একাধিক দেশে আসা যাওয়া করছেন বলে তদন্তকারী কর্মকর্তারা বলছেন।
এছাড়া গ্রেনেড হামলা মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত বিএনপির টিকিটে কুমিল্লা থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ সৌদি আরবে পলাতক রয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
অন্যদিকে বিএনপি সরকারের সময় প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থা বা ডিজিএফআই-এর দ্বিতীয় শীর্ষ ব্যক্তি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এ টি এম আমিন। পরবর্তীতে সেনা-সমর্থিত তত্বাবধায়ক সরকারের সময় ডিজিএফআই-এর প্রধান হয়েছিলেন তিনি। মেয়াদ শেষ হলে আমেরিকায় চলে যান সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা।
এছাড়া লে. কর্নেল (অব.) সাইফুল ইসলাম বর্তমানে কানাডায় অবস্থান করছেন বলে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে খবর বেরিয়েছে।
এদিকে কারাগারে থাকা ও জামিনে থাকা দণ্ডিত আসামিরা দুই মামলায় জেল আপিল ও নিয়মিত আপিল করেছেন। সাধারণত বছর ও মামলার ক্রম অনুসারে ডেথ রেফারেন্সের শুনানি হয়ে থাকে। চলতি বছরের ২০ জুন পর্যন্ত ডেথ রেফারেন্স মামলার সংখ্যা ছিল ৮৫০টি। এখন ২০১৬ সালে আসা ডেথ রেফারেন্সের শুনানি শুরু হয়েছে। তবে গুরুত্ব বিবেচনায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতেও ডেথ রেফারেন্স শুনানি হয়। ডেথ রেফারেন্স মামলা শুনানির জন্য বর্তমানে হাইকোর্টে তিনটি বেঞ্চ রয়েছে। ইতিমধ্যে দণ্ডিতদের মধ্যে পলাতক আসামিদের পক্ষে মামলা পরিচালনার জন্য রাষ্ট্র দুজন আইনজীবীও নিয়োগ দিয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র মোহাম্মদ সাইফুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘২১ আগস্টের মামলার পেপারবুকসহ নথিপত্র সতর্কতার সঙ্গে যাচাই–বাছাই চলছে, যা একবারেই শেষ পর্যায়ে। শুনানি–পূর্ব প্রস্তুতির এই প্রক্রিয়া শেষে বিধি অনুসারে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’
সান নিউজ/এমকেএইচ