নিজস্ব প্রতিবেদক: চ্যানেল আইয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ফরিদুর রেজা সাগর এবং পরিচালক ও বার্তাপ্রধান শাইখ সিরাজের নামের দুটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। মেহজাবীন চৌধুরী ও আফরান নিশো অভিনীত ‘ঘটনা সত্য’ নাটকে শারীরিক প্রতিবন্ধী ও প্রতিবন্ধিতা নিয়ে ভ্রান্ত ও ক্ষতিকর ধারণা দেয়ার অভিযোগে বিচারিক আদালতে মামলা দুটির আবেদন করা হয়।
ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম (সিএমএম) আদালতে দুটি আবেদনেই তাদেরকে আসামি হিসেবে রাখা হয়েছে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার আদায় আন্দোলনের কর্মী বশির আল হোসাইন বাদী হয়ে মামলার আবেদন দুটি করেন।
বাদীর অভিযোগ, নাটকটিতে যে ধারণা দেয়া হয়েছে এবং যেসব শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, তাতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, তাদের মা-বাবা ও পরিবার ঝুঁকিতে পড়বে।
আবেদন দুটির একটিতে আসামি হিসেবে নাম দেয়া হয়েছে চ্যানেল আইয়ের এমডি ফরিদুর রেজা সাগর, বার্তাপ্রধান শাইখ সিরাজ, ‘ঘটনা সত্য’ রচয়িতা মঈনুল সানু, ওই নাটকের পরিচালক রুবেল হাসান, অভিনেতা আফরান নিশো ও মেহজাবীন চৌধুরীকে।
অপর মামলায় আসামি করা হয়েছে ফরিদুর রেজা সাগর, শাইখ সিরাজ, অনুষ্ঠান পরিকল্পনাকারী জাহিদ নেওয়াজ খান, প্রযোজক রাজু আলিম, উপস্থাপক সোমা ইমলাম ও ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমনকে।
ঢাকার অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম আবু বকর ছিদ্দিকীর কাছে বাদী জবানবন্দি দেন। বিচারক জানিয়েছেন, আদেশ পরে দেয়া হবে।
মামলার বাদী, সব সাক্ষী, আইনজীবীদের একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী।
কেন সমালোচিত ‘ঘটনা সত্য’
বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুর জন্ম নেয়ার কারণ হিসেবে কুসংস্কার প্রচার করে সমালোচনায় পড়েন ‘ঘটনা সত্য’ নাটকের অভিনেতা আফরান নিশো ও মেহজাবীন চৌধুরী।
সত্য বলে নাটকটিতে যা প্রচার হয়েছে তার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই; বরং তা অনেক সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে থাকা একটি অপপ্রচার মাত্র।
সমালোচনার পর নির্মাতা বলছেন, তাদের ভুল হয়ে গেছে। নাটকটি তারা তাদের ইউটিউব চ্যানেল থেকে নামিয়ে নিয়েছেন। তবে তারা নামালেও অন্য অনেক চ্যানেলে সেটি ঠিকই চলছে।
যেভাবে ছড়ানো হয় কুসংস্কার
বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ও পায়ের সমস্যা নিয়ে শিশুর জন্মের কারণ হিসেবে মা-বাবার ‘অপরাধ’কে উপজীব্য করে এই নাটকের কাহিনি এগিয়েছে।
নাটকের প্রধান দুই চরিত্র একজন গাড়িচালক ও একজন গৃহপরিচারিকা। গাড়িচালকের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন আফরান নিশো, আর গৃহপরিচারিকার চরিত্রে মেহজাবীন।
নাটকে দেখানো হয়েছে, নিশো গাড়ির তেল চুরি করে বিক্রি করে দেন। আর মেহজাবীন ফ্রিজের জিনিসপত্র না বলে নিয়ে যান। দুজনের মধ্যে একপর্যায়ে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে, তারা বিয়ে করেন এবং নাটকের শেষে তাদের সন্তানের জন্ম হয়।
সেই সন্তান পুরোপুরি সুস্থ নয়। জন্মের পর হাসপাতালের চিকিৎসক তাদের এসে বলেন, ‘আপনাদের বাচ্চাটা একটা স্পেশাল চাইল্ড হয়েছে।’
নিশো ভুল বোঝেন। তিনি মনে করেছেন, তাদের সন্তান কোনো বিশেষ গুণ নিয়ে জন্ম নিয়েছে।
এরপর চিকিৎসক তাকে ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘আসলে আপনি যে স্পেশালের কথা ভাবছেন, সেটা আসলে ঠিক না। স্পেশাল বলতে আসলে যেটা বুঝিয়েছি, সেটা হচ্ছে আপনাদের বাচ্চাটা একটা বিশেষ কেয়ারে রাখা হয়েছে, স্পেশাল কেয়ারে রাখা হয়েছে। বিশেষ যত্নে আছে ও।’
পরে চিকিৎসক আরও ব্যাখ্যা করে বলেন, শিশুটির ডান পাটা ভবিষ্যতে মনে হয় না ভালো হবে। সে আর ১০টা বাচ্চার মতো স্বাভাবিকভাবে হাঁটাচলা করতে পারবে না।
মেহজাবীন কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকেন, তিনি মাফ চাইবেন সৃষ্টিকর্তার কাছে। তিনি অপরাধ করেছেন, কিন্তু তার সন্তান কোনো অপরাধ করেনি।
নিশো বলেন, ‘বাটপারির শিক্ষা দিছে।’
নাটকের শেষে দৈববাণীর মতো ভয়েসওভারে আসে, ‘পাপের ফল মানুষ কোনোভাবেই এড়াতে পারে না। প্রত্যেককেই তার নিজ নিজ কর্মের ফল কোনো না কোনোভাবে ভোগ করতে হয়, এটাই নিয়তি। কখনো কখনো আমাদের কোনো অনৈতিক কাজ বাস্তব জীবনে চরম শাস্তি নিয়ে আসতে পারে, যা হয়তো জীবনব্যাপী ভোগ করতে হয়।’
পরে আবার বলা হয়, ‘ঘটনাটি কিন্তু সত্য।’
গত ২৪ জুলাই নাটকটি সিএমভি নামে একটি ইউটিউব চ্যানেলে প্রথম প্রকাশ হয়, তবে সেই চ্যানেলে এখন আর নাটকটি দেখা যাচ্ছে না।
প্রতিবন্ধী বা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুর জন্মের পেছনে বাবা-মায়ের অতীত কর্মকাণ্ডের কোনো ভূমিকা আছে, এটি চিকিৎসাবিজ্ঞানে কখনো কোথাও উঠে আসেনি।
ভুল হয়েছে, বলছেন নির্মাতা
এই নাটকের মাধ্যমে সমাজে ভুল বার্তা যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন পরিচালক রুবেল হাসানও। তিনি বলেন, ‘যখনই আমরা বুঝতে পেরেছি এই বিষয়টি ঠিক হয়নি, তখনই নাটকটি আমাদের চ্যানেল থেকে সরিয়ে ফেলেছি। এটি ঠিক করে আবার ছাড়ব।’
‘কিন্তু নাটকটি তো বিভিন্ন চ্যানেলে চলছে, সেগুলোর কী হবে?’
এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা নাটকটি ঠিক করে যখন আপলোড করব, তখন সেই চ্যানেলগুলোর বিরুদ্ধে রিপোর্ট করতে পারব।’
কুসংস্কারকে উপজীব্য করে নাটকে অভিনয়ের বিষয়ে মেহজাবীন বা নিশোর বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
নিশোর ফোন বন্ধ আর মেহজাবীন ফোন ধরেননি।
তবে রুবেল জানান, তিনি এবং দুই অভিনয়শিল্পী—তিনজনই তাদের ভুলের বিষয়টি স্বীকার করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দিয়েছেন।
সেই পোস্টে বলা হয়েছে, ‘ঘটনা সত্য’ নাটকের নাট্যকার, পরিচালক, প্রযোজক, শিল্পী এবং কলাকুশলীদের পক্ষ থেকে আমরা গভীরভাবে দুঃখ প্রকাশ করছি। আপনাদের অনেকেই জানিয়েছেন, এ নাটকের মাধ্যমে ভুল বার্তা দেয়া হয়েছে। অভিযোগটির সাথে আমরা সহমত পোষণ করছি।’
বিষয়টি একেবারেই অনাকাঙ্ক্ষিত উল্লেখ করে বলা হয়, যারা আমাদের নাটক ‘ঘটনা সত্য’র এ বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত করেছেন, সবাইকে অকুণ্ঠ ধন্যবাদ জানাই। সেই সাথে জানাই, প্রথম বার্তা পাওয়ার পরপরই আমরা উপলব্ধি করি, অসাবধানতাবশত নাটকে আমরা ভুল একটি বার্তা পৌঁছে দিয়েছিলাম। বিষয়টি বুঝতে পেরে আমরা সঙ্গে সঙ্গেই নাটকটি ইউটিউব থেকে সরিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নেই এবং প্রয়োজনীয় সংশোধনের কাজ চলছে।
‘ভবিষ্যতে এমন প্রযোজনা তৈরি করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি যা সঠিক বার্তা সমাজে ছড়িয়ে দেয় এবং দর্শকদের সঠিক পথে পরিচালিত করে।’
সান নিউজ/এফএআর