ফারুক আহমাদ আরিফ
বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা কিছুটা কমলেও উদ্বেগজনক পরিস্থিতির এখনো অবসান হয়নি। দেশে এখনো বছরে প্রায় দেড় শ মানুষের মৃত্যু হচ্ছে এই প্রাকৃতিক দুর্যেোগে। নিহতদের মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশই কৃষক। গত দশ বছরে দেশে বজ্রপাতে দুই হাজার ৩৭৪ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে বলে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত থেকে জানা গেছে। তারমধ্যে ২০১১ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত এক হাজার ৯০০ জন ও ২০১৮ হতে ২০২০ সাল পর্যন্ত ৪৭৪ জনের মৃত্যু হয়েছে।
বর্ষার মৌসুমে দেশের বিভিন্ন স্থানে বজ্রপাতে এসব মানুষের মৃত্যু ঘটছে। এসব মৃত্যু অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। কিছুটা সচেতন হলেই বজ্রপাতে মৃত্যুর পরিমাণ কমবে বলে আশাবাদ বিশ্লেষক ও পরিবেশবিদদের।
ফিনল্যান্ডের বজ্রপাতবিষয়ক গবেষণা সংস্থা ভাইসালার হিসাবে, বাংলাদেশে ২০১৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর ৪০ লাখ বা তার বেশিসংখ্যক বজ্রপাত মেঘ থেকে ভূমিতে নেমে আসে। ২০১৯ সালে তা প্রায় ১০ লাখ কমে যায়। সর্বশেষ গত বছর সংখ্যাটি দাঁড়িয়েছে ২৫ লাখের কিছু কম।
ভাইসালার হিসাবে, বজ্রপাতে গত ২০২০ সালে ১৪৪ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ২০১৯ সালে ১৫৫ জন ও ২০১৮ সালে ১৭৫ জনের প্রাণ গেছে। বজ্রপাতের ক্ষেত্রে একটি অস্বাভাবিক বছর ছিলো ২০১৬ সাল। সে বছর প্রায় ৪৩ লাখ বজ্রপাত হয়। আর এতে মৃত্যু হয় ২৬৩ জন মানুষের।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ সালে ১৭৯ জন, ২০১২ সালে ৩০১ জন, ২০১৩ সালে ২৮৫ জন, ২০১৪ সালে ২১০ জন, ২০১৫ সালে ২৭৪ জন এবং ২০১৬ সালে ৩৫০ জন ও ২০১৭ সালে ৩০১ জন মারা গেছেন বজ্রপাতে। এছাড়া বিপুল সংখ্যক গবাদি পশু মারা গেছে।
বিবিসি জানায়, বাংলাদেশে বজ্রপাত নিয়ে গবেষণা করেছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এম এ ফারুখ। তিনি বলেন, বাংলাদেশে বজ্রপাতের মূল কারণ দেশটির ভৌগলিক অবস্থান। বাংলাদেশের একদিকে বঙ্গোপসাগর, এরপরই ভারত মহাসাগর। সেখান থেকে গরম আর আর্দ্র বাতাস আসছে। আবার উত্তরে রয়েছে পাহাড়ি এলাকা, কিছু দূরেই হিমালয় রয়েছে, যেখান থেকে ঠাণ্ডা বাতাস ঢুকছে। এই দুইটা বাতাসের সংমিশ্রণ বজ্রপাতের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করছে।
এদিকে বজ্রপাত থেকে বাঁচতে (২৯ জুলাই) বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতর ২০টি জরুরি পরামর্শ দিয়েছে।
পরামর্শগুলো হলো: (১) বজ্রপাত ও ঝড়ের সময় বাড়ির ধাতব কল, সিঁড়ির ধাতব রেলিং, পাইপ ইত্যাদি স্পর্শ করবেন না।
(২) প্রতিটি ভবনে বজ্র নিরোধক দণ্ড স্থাপন নিশ্চিত করুন।
(৩) খোলাস্থানে অনেকে একত্রে থাকাকালে বজ্রপাত শুরু হলে প্রত্যেকে ৫০ থেকে ১০০ ফুট দূরে দূরে সরে যাবেন।
(৪) কোনো বাড়িতে যদি পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকে তাহলে সবাই এক কক্ষে না থেকে আলাদা আলাদা কক্ষে যাবেন।
(৫) খোলা জায়গায় কোনো বড় গাছের নিচে আশ্রয় নেয়া যাবে না। গাছ থেকে চার মিটার দূরে থাকতে হবে।
(৬) ছেঁড়া বৈদ্যুতিক তার থেকে দূরে থাকতে হবে। বৈদ্যুতিক তারের নিচ থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকতে হবে।
(৭) ক্ষয়ক্ষতি কমানোর জন্য বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির প্লাগগুলো লাইন থেকে বিচ্ছিন্ন রাখতে হবে।
(৮) বজ্রপাতে আহতদের বৈদ্যুতিক শকে মতো করেই চিকিৎসা দিতে হবে।
(৯) গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে বজ্রপাত বেশি হয়। এই সময়ে আকাশে মেঘ দেখা গেলে ঘরে অবস্থান করুন।
(১০) যত দ্রুত সম্ভব দালান বা কংক্রিটের ছাউনির নিচে আশ্রয় নিন।
(১১) বজ্রপাতের সময় বাড়িতে থাকলে জানালার কাছাকাছি বা বারান্দায় থাকবেন না এবং ঘরের ভেতরে বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম থেকে দূরে থাকবেন।
(১২) ঘনকালো মেঘ দেখা গেলে অতি জরুরি প্রয়োজনে রাবারের জুতা পরে বাইরে বের হতে পারেন।
(১৩) উঁচু গাছপালা, বৈদ্যুতিক খুঁটি, তার, ধাতব খুঁটি ও মোবাইল টাওয়ার ইত্যাদি থেকে দূরে থাকুন।
(১৪) বজ্রপাতের সময় জরুরি প্রয়োজনে প্লাস্টিক বা কাঠের হাতলযুক্ত ছাতা ব্যবহার করুন।
(১৫) বজ্রপাতের সময় খোলা জায়গা, মাঠ বা উঁচু স্থানে থাকবেন না।
(১৬) কালো মেঘ দেখা দিলে নদী, পুকুর, ডোবা, জলাশয় থেকে দূরে থাকুন।
(১৭) বজ্রপাতের সময় শিশুদের খোলা মাঠে খেলাধুলা থেকে বিরত রাখুন এবং নিজেরাও বিরত থাকুন।
(১৮) বজ্রপাতের সময় খোলা মাঠে থাকলে পায়ের আঙুলের ওপর ভর দিয়ে এবং কানে আঙুল দিয়ে মাথা নিচু করে বসে পড়ুন।
(১৯) বজ্রপাতের সময় গাড়ির মধ্যে অবস্থান করলে, গাড়ির ধাতব অংশের সঙ্গে শরীরের সংযোগ ঘটাবেন না, সম্ভব হলে গাড়িটিকে নিয়ে কোনো কংক্রিটের ছাউনির নিচে আশ্রয় নিন।
(২০) বজ্রপাতের সময় মাছ ধরা বন্ধ রেখে নৌকার ছাউনির নিচে অবস্থান করুন।
অবশ্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর থেকে এর আগে বজ্রপাত প্রতিরোধে সারাদেশে প্রায় ১৩ লাখ তালগাছ রোপণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিলো।