ব্যুরো প্রধান, চট্টগ্রাম :
বন্দরনগরী চট্টগ্রামের ফুসফুস হিসেবে খ্যাত সিআরবি। এখানে রয়েছে শতবর্ষী শত শত শিরীষ গাছ ও পাহাড়-টিলা। যা কেটে কোনোভাবেই হাসপাতাল নির্মাণে রাজী নন চট্টগ্রামবাসী। বিশিষ্টজনদের মতে, গাছ ও পাহাড় কেটে বিনাশ করা হলে নগরীর এই ফুসফুস ধ্বংস হয়ে যাবে।
শুধু তাই নয়, নগরীর তাপমাত্রা ২ থেকে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বাড়তে পারে। সেই সঙ্গে নগরের বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ ১০ শতাংশ বেড়ে যাবে। এ অবস্থায় সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণ করা হলে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।
নগরীর জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. সুশান্ত বড়ুয়া এ প্রসঙ্গে বলেন, আমরা হাসপাতাল চাই না, তা নয়। তবে ফুসফুস ধ্বংস করে হাসপাতাল করতে দেয়া হবে না। আমরা আগে ফুসফুস বাচাতে চায়। পরে হাসপাতাল।
তিনি প্রশ্ন রাখেন, হাসপাতাল নির্মাণ করার জন্য শুধু সিআরবি কেন, নগরীর বিভিন্নস্থানে রেলওয়ের বিস্তীর্ণ জায়গা খালী বা অবৈধ দখলে আছে। সেখানেও তো হাসপাতাল করা যায়। নগরীর ফুসফুস সিআরবি বাচিয়ে হাসপাতাল করতে হবে।
পরিবেশবিদ ও কর্ণফুলীর গবেষক ড. ইদ্রিস আলী বলেন, সিআরবির মুক্ত পরিবেশ নগরীর মানুষের স্বস্তির জায়গা। হাসপাতাল হলে সেটির মারাত্নক বিপর্যয় ঘটাবে। এখানকার ইকো সিস্টেম-কীট-পতঙ্গ, পাখির হাঁটাচলা বাধাগ্রস্ত করবে। পরিবেশ রক্ষায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যতই পদক্ষেপ নিক, হাসপাতালের জৈব পদার্থ এই অঞ্চলকে হুমকির মুখে ফেলবে।
তবে এ বিষয়ে ভিন্ন কথা বলছেন হাসপাতাল ভবন নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক ও রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (সেতু) মো. আহসান জাবির। তিনি বলেন, হাসপাতাল নির্মাণে শতবর্ষী গাছ ও পাহাড় কাটার বিষয়ে যেসব কথা আসছে, তা অমুলক। এটি শিরীষতলায় হচ্ছে না। এটি যেখানে হচ্ছে সেখানে একটি মাত্র শতবর্ষী শিরীষ গাছ আছে, সেটিও কাটা পড়বে না। পাহাড়-টিলা অক্ষত রেখে হাসপাতাল নির্মাণ করা হবে। প্ল্যান ওভাবেই করা হয়েছে।
তিনি বলেন, যারা গাছ ও পাহাড় কাটার কথা বলছেন তারা না বুঝে বলছেন। ওই জায়গায় কতিপয় অবৈধ দখলদার ও স্বার্থান্বেষি মহল এ বিষয়ে ভুল বোঝাচ্ছেন। হাসপাতাল নির্মাণে ইতোমধ্যে এনভায়রমেন্ট এসেসমেন্টের কাজ চলছে। এ জন্য পরামর্শক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সরকার হাসপাতাল নির্মাণে অনুমোদন দিয়েছে। আমরা সেটির বাস্তবায়ন করছি।
আহসান জাবির আরও বলেন, হাসপাতাল নির্মাণে গত বছরের মার্চে ইউনাইটেড গ্রুপের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর হলেও স্থানীয়ভাবে বাধা ও করোনা সংক্রমণের কারণে কাজ এগোয়নি। প্রতিষ্ঠানটি সম্প্রতি আমাদের ডিটেইল ডিজাইন সাবমিট করেছে। এনভায়রনমেন্ট ইমপেক্ট এসেসমেন্ট প্রতিবেদন পেলে সিডিএর অনুমোদন চাওয়া হবে। তবে প্রকল্পের জায়গা থেকে কিছু কোয়ার্টার ইতোমধ্যে সরানো হয়েছে। তাদের অন্যত্র বাসস্থানের ব্যবস্থা করা হবে।
প্রকল্পের তথ্যমতে, চট্টগ্রাম নগরীর এমএ আজিজ স্টেডিয়ামের পশ্চিম পাশে পাহাড়ে ঘেরা রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের সদর দপ্তর (সিআরবি)। সড়কের বাম পাশে রেলওয়ে হাসপাতাল ও হোটেল তাসফিয়া গার্ডেন। তার পাশে মোট ৬ একর খালী জমিতে হাসপাতালটি নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পের পরিকল্পনা ও সহযোগী সংস্থা বাংলাদেশ সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব কর্তৃপক্ষ (পিপিপি)। হাসপাতালটির সকল কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন ও পরিচালনা করবে ইউনাইটেড চট্টগ্রাম হাসপাতাল লিমিটেড।
এ প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ ধরা হয়েছে ১২ বছর। প্রকল্পের আওতায় ১০০ আসনের একটি মেডিকেল কলেজ, ৫০ আসনের একটি নার্সিং ইনস্টিটিউট এবং দুই ধাপে মোট ৫০০ শয্যার একটি হাসপাতাল নির্মাণ করা হবে। প্রকল্পের প্রথম ধাপে ২ দশমিক ৪২ একর এবং দ্বিতীয় ধাপে ৩ দশমিক ৫৮ একর জমি ব্যবহার করবে ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজ। এতে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা খরচ হবে। ৫০ বছর পর প্রকল্পের মালিকানা হবে বাংলাদেশ রেলওয়ে। আর এই হাসপাতাল হবে বিশ^মানের।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল সূত্র জানায়, ২০১৩ সালের ১৪ আগস্ট অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির (সিসিইএ) সভায় প্রকল্পটি পিপিপিতে বাস্তবায়নের নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। গত বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি পিপিপি প্রকল্পটি অনুমোদন দেওয়া হয় সিসিইএ সভায়। সর্বশেষ ২০২০ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী চূড়ান্ত অনুমোদন দেন। এরপর গত বছরের ১৮ মার্চ ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজ অ্যান্ড কো¤পানি লিমিটেডের সাথে রেলওয়ের চুক্তি স্বাক্ষর হয়।
এরপর থেকে হাসপাতাল নির্মাণে বিরোধীতা করে প্রথম আন্দোলনে নামে রেলওয়ে কর্মচারী ইউনিয়ন (সিবিএ) ও শ্রমিক সংগঠনগুলো। তাদের আতঙ্ক ছিল বরাদ্দ পাওয়া সরকারি বাসা হাত ছাড়া হওয়া। আলাপ-আলোচনায় পূনর্বাসনের শর্তে তারা এখন প্রায় নমনীয়। এরপর বিরোধীতা শুরু করে হাসপাতাল নির্মাণের বরাদ্দকৃত জায়গায় লীজ পাওয়া ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক ও অবৈধ দখলদাররা। যা এখন ছড়িয়ে পড়েছে চট্টগ্রামের বিভিন্ন পরিবেশবাদি ও সাংস্কৃতিক সংগঠন পর্যন্ত। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরশেন ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষও (সিডিএ) সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণে বিরোধীতা করে আসছে।
সান নিউজ/