নিজস্ব প্রতিবেদক: নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাসেম ফুডস কারখানায় আগুনে প্রত্যেক নিহত শ্রমিকের পরিবারকে এক কোটি ও আহত শ্রমিককে ৩৫ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণের বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত দেয়নি আদালত। রোববার (১১ জুলাই) এ ব্যাপারে রিটের শুনানি শেষে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের আদালত বলেন, `একটু অপেক্ষা করেন। দেখি হয়।’
শনিবার (১০ জুলাই) আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক), বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) এবং সেফটি অ্যান্ড রাইটস সোসাইটির পক্ষে রিট আবেদনটি করেন আইনজীবী মো. শাহিনুজ্জামান।
আগুনে পুড়ে আহতদের চিকিৎসা নিশ্চিত করতে অ্যাটর্নি জেনারেলকে স্বাস্থ্য সচিব ও শ্রম সচিবের সঙ্গে কথা বলতে বলেছে হাই কোর্ট। সেই সঙ্গে কতজন শ্রমিক আহত, চিকিৎসাধীন তার একটি তালিকা প্রকাশ করার কথাও আদালত বলেছে।
আগুনে হতাহত শ্রমিকদের জন্য ক্ষতিপূরণ চেয়ে করা এক রিট আবেদনে আইনজীবী সারা হোসেন আদালতের অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ চাইলে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম রোববার (১১ জুলাই) রাষ্ট্রপক্ষকে এ নির্দেশ দেন।
রিটের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী জেড আই খান পান্না, সারা হোসেন, অনীক আর হক, মো. শাহিনুজ্জামান। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সমরেন্দ্রনাথ বিশ্বাস ও বিপুল বাগমার।
আইনজীবী সারা হোসেন শুনানিতে আগুনে অর্ধশতাধিক মৃত্যুর তথ্য তুলে ধরে ক্ষতিপূরণের জন্য হাই কোর্টের অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ চান। বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম তখন বলেন, “আমার এখতিয়ার খুব সীমিত। একক বেঞ্চ হওয়ায় আমি তো কোনো রুল দিতে পারব না।”
রূপগঞ্জের ঘটনার প্রসঙ্গ ধরে বিচারক বলেন, “খুবই দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে। সমস্ত জাতি আমরা শোকাহত। এরকম ঘটনা আমরা আশা করি না। এ ঘটনায় তো ইতোমধ্যে একটি ফৌজদারী মামলা হয়েছে। এ মামলায় মালিক পক্ষের প্রায় সবাই গ্রেফতারও হয়েছে। বিচার তো সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এখন তদন্ত হবে।”
ক্ষতিপূরণের নির্দেশনার ব্যাপারে বিচারপতি ইনায়েতুর রহিম বলেন, “ঠিকই আছে, ক্ষতিপূরণের হকদার বটে। যতটুকু দেখেছি ঘটনার দিন আমাদের শ্রম প্রতিমন্ত্রী গিয়েছিলেন। উনারা আহতদের সরকারিভাবে ২ লাখ টাকা করে দেয়ার কথা বলেছেন। আজকে সকালে পত্রিকায় দেখেছি শ্রম সচিব হাসপাতালে গিয়ে আহতদের কিছু ক্ষতিপূরণ দেয়ার কথাও বলেছেন। সেটি পর্যাপ্ত কিনা জানি না।
“আর একটা বিষয় হল, যে মৃত্যুগুলো হয়েছে, এখন পর্যন্ত ৫২টি লাশের মধ্যে মাত্র একটা লাশের পরিচয় নিশ্চিত হয়ে হস্তান্তর করতে পেরেছে। বাকি ৫১টি লাশ চিহ্নিত করাই সম্ভব হচ্ছে না। ডিএনএ টেস্ট হবে এবং এই প্রক্রিয়া ২১ দিনের আগে সম্পন্ন হবে না। মৃতদেহগুলো যতক্ষণ পর্যন্ত চিহ্নিত না হচ্ছে, যতক্ষণ লাশগুলো তাদের আত্মীয়-স্বজনদের কাছে না যাচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত কীভাবে ক্ষতিপূরণ নির্ণয় করা হবে। আপানাদের (রিট আবেদনকারীদের) একটু অপেক্ষা করা দরকার।”
বিচারক বলেন, গত বছর ইউনাইটেড হাসপাতালের আগুন লাগার পর যেসব রোগীর মৃত্যু হয়েছিল, তাদের ক্ষতিপূরণের বিষয়ে রুল জারি না করে একটি অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ দিয়েছিল হাই কোর্ট।
“পরে আপিল বিভাগে প্রশ্ন উঠেছিল, রুল জারি না করে টাকার পরিমাণ নির্ধারণ করে ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করতে পারি কিনা। পরে বোধ হয় নিয়মিত মামলা ফাইল করে রুল জারি করে তারপর সেটেল হয়েছে। এক্ষেত্রে কিন্তু আমাদের কোর্টের সীমাবদ্ধতা আছে।”
রিটকারীদের উদ্দেশে বিচারপতি ইনায়েতুর রহিম বলেন, “আমার মনে হয় এটাই বোধয় প্রথম যে এরকম একটি ঘটনা ঘটার পর মালিকপক্ষকে খুব দ্রুত বিচারের আওতায় আইনের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। কাজ হচ্ছে, দেখা যাক। ক্ষতিপূরণের বিষয়ে একটু সময় দেন, আমার মনে হয় যে নিয়মিত কোর্ট চালু হলে নিয়মিত মামলা ফাইল করেন।”
আইনজীবী রেজাউল করিম এসময় বলেন, “চিকিৎসার খরচ যেন কোম্পানি বহন করে এরকম একটা নির্দেশনা দেন। তাদের অবহেলাতেই এ দুর্ঘটনা ঘটেছে।” তখন বিচারক বলেন, “কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ সবাই তো এখন জেলখানায়। আর কোম্পানি বিজ্ঞাপন দিয়ে বলেছে তারা খরচ দেবে। না দিলে আসবেন, বিষয়টা আমরা দেখব। একটু অপেক্ষা করেন। সময় যেতে দিন।”
আইনজীবী রেজাউল করিম বলেন, শ্রম আইনের ৩৪ ধারা অনুযায়ী শিশু এবং কিশোরদের নিয়োগই দেয়া যায় না। তারা সেটি লঙ্ঘন করেছে। বিচারক তখন বলেন, “এটাতে তো দ্বিমত পোষণ করছি না। কতজন শিশু আহত হল, কতজন শিশু নিহত হল, আমার মনে হয় একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র আগামী ১০ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে পেয়ে যাব। তখন ক্ষতিপূরণের বিষয়টি আমরা দেখব। এর মধ্যে মৃতদেহগুলো চিহ্নিত হয়ে যাক।”
গত বৃহস্পতিবার (৮ জুলাই) বিকেল সাড়ে পাঁচটায় নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাসেম ফুডসের কারখানায় ভয়াবহ আগুনে অর্ধশতাধিক শ্রমিকের মৃত্যু হয়, পাশাপাশি আহত হন অনেক শ্রমিক।
এ ঘটনায় শনিবার পুলিশ বাদি হয়ে একটি হত্যা মামলা দায়ের করে। সেই মামলায় হাসেম ফুডস লিমিটেডের মালিক মো. আবুল হাসেম ও তার চার ছেলেসহ আটজনকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে পাঠানো হয়।
এদিকে আগুনে নিহত ও আহত শ্রমিকদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে শনিবার রাতে হাই কোর্টে এই রিট আবেদন করা হয়। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক), বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) এবং সেফটি অ্যান্ড রাইটস সোসাইটির পক্ষে রিট আবেদনটি করেন আইনজীবী মো. শাহিনুজ্জামান।
আবেদনে নিহত শ্রমিকদের প্রত্যেকের পরিবারকে এক কোটি টাকা এবং আহত শ্রমিকদের প্রত্যেককে ৩৫ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশনা চাওয়া হয়। তবে অন্তর্বর্তীকালীন ক্ষতিপূরণ হিসাবে নিহত শ্রমিকদের প্রত্যেকের পরিবারকে ১০ লাখ এবং আহতদের ৫ লাখ টাকা করে দেওয়ার নির্দেশনা চাওয়া হয় আবেদনে।
এছাড়া রিট আবেদনে হাসেম ফুড লিমিটেড ও এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ হাসেম এবং তার পারিবারের অন্যান্য সদস্যদের ব্যাংক হিসাব চিহ্নিত করে তা ফ্রিজ করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতি নির্দেশনাও চাওয়া হয়।
আহতদের দ্রুত চিকিৎসা ও চিকিৎসা খরচ দিতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি নির্দেশনা চাওয়ার পাশাপাশি প্রতি মাসে হাই কোর্টে আহতদের চিকিৎসা সংক্রান্ত প্রতিবেদন দিতে নারায়ণগেঞ্জের সিভিল সার্জনের প্রতি নির্দেশনা চাওয়া হয় রিট আবেদনে।
দুই সপ্তাহের মধ্যে সুপারিশসহ এ ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন দিতে সংশ্লিষ্ট বিবাদীদের প্রতি নির্দেশনা চাওয়া হয়। শ্রম ও কর্মসংস্থান সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব, বাংলাদেশ ব্যাংক, পুলিশের মহাপরিদর্শক,রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, ডিআইজি (ঢাকা রেঞ্জ), নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার,রূপগঞ্জের উপজেলা নির্বাহী অফিসার, থানার (ওসি), সিভিল সার্জন, ফায়ার সার্ভিস, হাসেম ফুডস লিমিটেড এবং হাসেম ফুডস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে রিটে বিবাদী করা হয়।
আগুনের জন্য সংশ্লিষ্ট বিবাদীদের ব্যর্থতা ও অবহেলা কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না এবং কার্যকর তদন্তের মাধ্যমে বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করতে আইন অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না, তা জানতে রুল চাওয়া হয় রিট আবেদনে।
সান নিউজ/এফএআর