সান নিউজ ডেস্ক:
বিশ্বব্যাপী শ্রমজীবী মানুষের আন্তর্জাতিক সংহতি এবং উৎসবের দিন। মে দিবসের পেছনে রয়েছে শ্রমিক-শ্রেণির আত্মদান ও বিরোচিত সংগ্রামের ইতিহাস।
অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি থেকে ইউরোপে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কল্যাণে শিল্প-বিপ্লবের সূচনা হয়। সেটি ছিল পুঁজিবাদী বিকাশের প্রাথমিক যুগ। তখন শ্রমিকদের কাজের কোনো শ্রমঘণ্টা নির্ধারিত ছিল না। তাদের ছিল না ন্যূনতম মজুরির নিশ্চয়তা। শ্রম-দাসত্বের নিগড়ে তাদের মানবেতর জীবনযাপন করতে হতো। একজন শ্রমিককে প্রতিদিন ১৮ ঘণ্টা একটানা অমানবিক পরিশ্রমের কাজ করতে হতো।
ইউরোপ বিশেষত ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শ্রমিক-শ্রেণি নানাভাবে এই অমানবিক শ্রম-দাসত্বের তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকে। সদ্য কৃষি জমি থেকে উঠে আসা এই নবজাত শ্রমিকরা তাদের দুর্দশার জন্য প্রথমে যন্ত্রকেই দায়ী মনে করত। তারা তাদের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ নিরসনের জন্য বিভিন্ন কল-কারখানার যন্ত্র ভাঙতে শুরু করে। মেশিন বা যন্ত্র ভাঙলে অধিকার আদায় তো দূরের কথা, শ্রমিকরা নিজেরাই কর্মচ্যুত হয়, উল্টো কারখানা বন্ধ হয়ে যায়।
অগ্রসর চিন্তার বুদ্ধিজীবী এবং শ্রমিক সংগঠকরা বিক্ষুব্ধ শ্রমিক শ্রেণিকে এই ভ্রান্ত ধারণা থেকে মুক্ত করার পাশাপাশি তাদের অধিকার আদায়ের জন্য নতুন ধরনের ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের সূচনা করেন।
এই পটভূমিতে অসংগঠিতভাবেই অনধিক ১০ ঘণ্টা কাজের সময় নির্ধারণ ও অন্যান্য দাবিতে কয়লা খনি শ্রমিকরা স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন শুরু করে। ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে পেনসেলভেনিয়ার ধর্মঘটী কয়লা খনি শ্রমিকদের সাথে সেনা সদস্যদের সংঘর্ষে ১০ শ্রমিক নিহত হন।
১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দের ১ মে আমেরিকার শিকাগো শহরে উল্লিখিত অনধিক ১০ ঘণ্টা কাজের সময় নির্ধারণের দাবিতে শ্রমিকদের একটি মিছিল বের হয়। মিছিলটি শহরের কেন্দ্রস্থল হে মার্কেটের কাছে পৌঁছলে সৈনিকরা বাধা দেয় এবং সংঘর্ষ বেধে যায়। সৈনিকদের গুলিতে বহুসংখ্যক শ্রমিক নিহত ও আহত হন। শ্রমিকদের রক্তে ভেজা শার্ট নিয়ে মিছিল এগিয়ে চলে। আন্দোলন আরও তীব্র রূপ ধারণ করে। শ্রমিকদের রক্তে রঞ্জিত শার্ট লাল পতাকায় রূপান্তরিত হয়। ধর্মঘট ও প্রতিবাদ মিছিল চলে ৫ মে পর্যন্ত।
ইতোমধ্যে ৩ মে ছয়জন এবং ৫ মে আরও চারজন শ্রমিক পুলিশের গুলিতে নিহত হন। গ্রেফতার হন শত শত শ্রমিক। পরবর্তীকালে তাদের চারজনকে মৃত্যুদণ্ড এবং কারাদণ্ডও দেয়া হয়।
১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকান ফেডারেশন অব লেবারের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত সেন্ট লুইস শ্রমিক সম্মেলনে কাজের সময় ৮ ঘণ্টা নির্ধারণের দাবিতে ‘মে দিবস’ পালনের ঘোষণা দেয়া হয়। ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নামে খ্যাত কমিউনিস্ট ও সমাজতন্ত্রীদের প্যারিস সম্মেলন ১ মে তারিখটিকে দেশে দেশে শ্রমিক-শ্রেণির আন্তর্জাতিক সংহতি দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত হয়।
রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত না হলেও ১৮৯০ সাল থেকে ইউরোপের দেশে দেশে শ্রমিক-শ্রেণি ১ মে ‘মে দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছে।
রুশ বিপ্লব, পশ্চিমা দেশগুলোতে সংগঠিত শ্রমিক আন্দোলন এবং গণতান্ত্রিক অধিকার সম্প্রসারণের ফলে প্রথমে গুটিকয়েক দেশ ১ মে-কে শ্রমিক দিবস হিসেবে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাতিসংঘ ১ মে-কে সর্বজনীন শ্রমিক দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। অতঃপর অনেক দেশে এই দিনটিকে রাষ্ট্রীয় ছুটি ঘোষণা করা হয়।
মজার বিষয় হলো মার্কিন দেশের শ্রমিকদের রক্তে রঞ্জিত এই দিনটিকে জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক লেবার ডে (মে দিবস হিসেবে সমধিক পরিচিত) ঘোষণা করলেও খোদ আমেরিকা মে দিবসের স্বীকৃতি দেয় নি। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সোমবার লেবার ডে হিসেবে পালন করা হয়।
পাকিস্তান আমলে এই ভূখন্ডে মে দিবসের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ছিল না। কেবল ১৯৫৬ ও ৫৭ সালে পূর্ব বাংলার শাসক আওয়ামী লীগ সরকার ১ মে সরকারি ছুটি হিসেবে ঘোষণা করেছিল। কিন্তু ১৯৫৭ সালে আইউব খা সামরিক আইন জারি করার পর মে দিবসের ছুটি বাতিল করে দেয়।
মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু প্রথম মে দিবসকে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করেন।
সান নিউজ/সালি