সান নিউজ ডেস্ক:
পিলখানা হত্যা মামলায় ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের আপিলের ওপর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হওয়ার পর বিজিবি অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা ইউনিটের ব্যর্থতা তদন্ত করে তা জনসম্মুখে প্রকাশ করতে হবে বলে রায়ে সুপারিশ করেছেন হাইকোর্ট।
বুধবার (৮ জানুয়ারি) পিলখানা হত্যা মামলায় ২৯ হাজার ৫৯ পৃষ্ঠার এই ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের আপিলের ওপর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন বিচারপতি শওকত হোসেনের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিশেষ হাইকোর্ট বেঞ্চ। বেঞ্চের অন্য দুই সদস্য হলেন, বিচারপতি আবু জাফর সিদ্দিকী ও বিচারপতি নজরুল ইসলাম তালুকদার।
ওই রায়ে বিচারপতি নজরুল ইসলাম তালুকদার ১১ দফা সুপারিশ করেছেন। সুপারিশগুলো হল:
১ (ক) বাংলাদেশ রাইফেলসের নিরাপত্তা বিষয়ক ইউনিট (এরএসইউ) বিজিবির মেধাবী, সৎ ওচৌকস সদস্যের সমন্বয়ে নুতন ভাবে চেলে সাজানো এবংপিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহে দায়িত্বে অবহেলার জন্যেঘটনাকালীন সময়ে দায়িত্বে থাকা (এরএসইউ) এর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহন করা।
(খ) ২৫/২৬ ফেব্রুয়ারী ২০০৯ তারিখে বাংলাদেশ রাইফেলসের মহা-পরিচালকের দরবারে সশ্বস্ত্র আক্রমন এবং পিলখানায় মর্মান্তিক হত্যাকান্ডের ঘটনার পূর্বাভাস
সংগ্রহে প্রয়োজনীয় ব্যবস্তা গ্রহনে ব্যর্থতার জন্যে সরকারের সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা সংস্থাসহ দায়িত্বে অবহেলাকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহন করা।
২ (ক) গোয়েন্দা বাহিনী ও নিরাপত্তা কর্মীদের বাহ্যিক তৎপরতা দৃশ্যমান হলেও ভেতরে অন্ত:স্বার শুন্যতাপরিলক্ষিত হয়। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের অধিকতর সতর্ক করা।
(খ) বিডিআরে তীব্র অসন্তোষ এবং প্রকাশ্যে লিফলেট বিতরণ তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও গুরুত্বপূর্ন রাজনৈতিক নেতা সহ কমান্ডিং অফিসারদের নজরে আসা সত্বেও তারা উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণে উদ্যোগ গ্রহণ না করে উদাসীনতার পরিচয় দিয়েছে। ভবিষ্যতের জন্যে সংশ্লিষ্টদের মনযোগী ও সতর্ক হওয়া।
৩ (ক) মানবিক গুনাবলী সম্পন্ন মেধাবী, দূরদৃষ্টি সম্পন্ন দক্ষ, তড়িৎ ও সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহনে পারদর্শী, উপযুক্ত সেনা কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে বিজিবির মহা-পরিচালক সহ অন্যান্য কর্মকর্তাদের প্রেষনে নিয়োগের কার্যকারী ব্যবস্থা গ্রহন করা।
(খ) বিজিবির অফিসার সহ সকল পদের সদস্যদের মানবিক গুনাবলী, দায়িত্ব, কর্তব্য, বিভাগীয় আইন ও শৃঙ্খলা সম্পর্কিত প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহনের কার্যকারী ব্যবস্থা গ্রহন।
৪ (ক) সামরিক/বেসামরিক সকল শ্রেণীর কর্মকর্তাদের বৃটিশ আমলের আমলাতান্ত্রিক মনোভাব পরিহার করে সকলকে সেবার মানসিকতা নিয়ে দেশ প্রেমের সাথে কাজ করার প্রশিক্ষন প্রদান করা।
(খ) ৩০ লক্ষ শহীদের আত্নদান ও ২ লক্ষে মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশকে সামনে এগিয়ে নেয়া এবং বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর সংগ্রামে পেশা, পদবী, সামাজিক পরিচয়কে প্রাধান্য না দিয়ে সংবিধানে উল্লেখিত মূলনীতি অনুস্বরন করে সকলের প্রতি মানবিক আচরন ও সম্মান প্রদর্শনের মানষিকতায় বাহিনীকে গড়ে তোলা।
৫ (ক) স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সহ মন্ত্রনালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের বিজিবি সহ অধীস্থ সকল বাহিনীর সদস্যদের সুবিধা/অসুবিধা সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয় আন্তরিকতা ও বিচক্ষনতার সাথে দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
(খ) বাহিনীর মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টির পূর্বেই কর্তৃপক্ষকে আইন সম্মত ও সম্মানজনক উপায়ে তার সমাধান খুঁজে বের করা।
৬ (ক) বিজিবি সহ অন্যান্য বাহিনীর মধ্যে চাকুরী বিধি মতে মর্যাদার পার্থক্য যতদুর সম্ভব কমিয়ে আনা এবং সকলকে সংবিধান সম্মত উপায়ে আইনানুগ ভাবে সম্মানের সাথে প্রজাতন্ত্রের চাকুরী করার সুযোগ সৃষ্টি করা।
(খ) বিজিবির সদস্যদের পদোন্নতি, বেতন, ভাতা, রেশন, ছুটি, আবাসিক সমস্যা, চিকিৎসা ও সন্তানদের শিক্ষা গ্রহনের সুবিধা সহ অন্যান্য ক্ষেত্রে উদ্ভুত সমস্যা দ্রুত সমাধানে মন্ত্রনালয় সহ সরকারের সময়োপযোগী ব্যবস্থা গ্রহন করা।
৭ (ক) আহনানুগ কোন বাধা না থাকলে অন্যান্য বাহিনীর ন্যায় বিজিবির সদস্যদের জাতিসংঘের শান্তি মিশনে অংশ গ্রহণের ব্যবস্থা গ্রহন করা।
(খ) বাহিনীর প্রতিটি সদস্যের প্রতি সম-আচরন করা। দায়িত্বপ্রাপ্ত কমান্ডিং অফিসার কতৃক অধীনস্তদের প্রতি আত্নমর্যাদা হানিকর যে কোন আচরন থেকে বিরত থাকা, কারন তারা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী।
৮ (ক) ২৫/২৬ ফেব্রুয়ারী ২০০৯ তারিখে পিলখানায় নিহত সামরিক, আধা-সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তির পরিবারকে সরকারের পক্ষ থেকে উপযুক্ত ক্ষতিপুরন প্রদান করা।
(খ) সেনা কর্মকর্তা সহ নিহতদের সন্তান বা পরিবারের উপযুক্ত সদস্যদের আর্থিক,সামাজিক ও পারিবারিক নিরাপত্তা বিধানে যোগ্যতার ভিত্তিতে চাকুরীর ব্যবস্থা গ্রহন করা।
(গ) সামরিক কর্মকর্তা সহ নিহতদের সম্মানে পিলখানা সহ দেশের সকল সেনানিবাস, বিজিবির সকল সেক্টর হেড কোয়ার্টারে নাম ফলক নির্মান করা।
৯। (ক) পুনর্গঠিত বিজিবি সংবিধান ও নেতৃত্বের প্রতি অবিচল আস্থা রেখে দেশের সীমান্ত রক্ষা সহ তাদের উপর অর্পিত সকল দায়িত্ব পেশাদার বাহিনী হিসাবে দেশ-প্রেম,সততা ও শৃঙ্খলার সাথে পালনের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে বিজিবির হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা।
(খ) দেশের সীমান্তরক্ষী হিসাবে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রাথমিক নিরাপত্তা বাহিনীর (First Defense Force) দায়িত্বে থাকা বিজিবিকে শক্তিশালী বাহিনী রুপে গড়ে তোলার কার্যকারী পদক্ষপ গ্রহন করা।
১০ (ক) সেনা বাহিনী, বিমান বাহিনী, নৌ বাহিনী, বিজিবি, পুলিশ ও র্যাব সহ অন্যান্য বাহিনীকে 'অপারেশন ডাল ভাতের ন্যায় অন্য কোন আর্থিক কর্মসূচীতে সম্পৃক্ত করার সিদ্ধান্ত পরিহার করা। আর্থিক লেনদেন ও লাভ-ক্ষতির হিসাব-নিকাশ বাহিনীর সংশ্লিষ্ট সদস্যদের মধ্যে অহেতুক বিভেদ ও নৈতিক স্খলনের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশ রাইফেলসের ক্ষেত্রে 'অপারেশন ডালভাত উৎকৃষ্ট উদাহরন।
(খ) পিলখানা হত্যাকান্ডে 'ঘটনার পিছনের ঘটনা' উৎঘাটন করে জাতির সামনে প্রকৃত স্বার্থান্বেষী মহলের চেহারা উন্মোচনের জন্যে জনস্বার্থে সরকার প্রয়োজন মনে করলে আইনানুগভাবে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের দ্বারা তদন্ত কমিশন গঠনের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহন করা।
১১ (ক) সমাজের সকল স্তরে নৈতিকতা পুনরুদ্ধার ও জাতিগঠনের জন্যে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে উচ্চ শিক্ষায় বাধ্যতামূলক নীতিশাস্ত্র (Ethics) শিক্ষাদান অতি জরুরী। নৈতিকতার অবক্ষয়ের কারণে সমাজের প্রতিটি স্তরে অসম প্রতিযোগিতা দৃশ্যমান। আইনের শাসন, ন্যায়বিচার, সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠায় নীতিশাস্ত্রের (Ethics) অধ্যায়ন।