নিজস্ব প্রতিবেদক: ভারতের কেরালায় বাংলাদেশি তরুণীকে যৌন নিগ্রহের ঘটনায় গ্রেপ্তার টিকটক হৃদয় মানবপাচারের আন্তর্জাতিক চক্রের সদস্য। বিশ্বের কয়েকটি দেশে এই চক্রটি সক্রিয়।
ফেসবুকে তরুণীকে যৌন নিগ্রহের ভাইরাল ভিডিওর সূত্র ধরে ভারতের কেরালায় গ্রেপ্তার হন ছয়জন। এরা সবাই বাংলাদেশি বলে জানাচ্ছে ভারতের পুলিশ। তাদের মধ্যে ঢাকার মগবাজারের হৃদয় বাবু ওরফে ‘টিকটক হৃদয়’ বেশ আলোচিত। টিকটকের আড়ালে হৃদয় দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও ভারতের কয়েকটি রাজ্যের অপরাধীদের নিয়ে গড়া মানবপাচারের আন্তর্জাতিক চক্রের সমন্বয়ক। পুলিশ বলছে, তাদের নেটওয়ার্ক ভারত-বাংলাদেশ ছাপিয়ে দুবাইসহ বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে বিস্তৃত।
শনিবার বিকাল সাড়ে তিনটার দিকে রাজধানীর শ্যামলীতে তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনারের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. শহিদুল্লাহ।
শহিদুল্লাহ বলেন, ‘বাংলাদেশি তরুণীকে নৃশংস যৌন নির্যাতনের একটি ভিডিও ভাইরাল হওয়ার ঘটনায় বাংলাদেশ ও ভারতের পুলিশ খুবই দ্রুততার সঙ্গে তদন্তে নেমে আসামি ও ভিকটিমকে শনাক্ত করে। ইতোমধ্যে ভারতে ছয়জন গ্রেপ্তার হয়েছে। তারা সবাই আন্তর্জাতিক নারী পাচার গ্রুপের বলে নিশ্চিত হয়েছি। যাদেরকে পুলিশের এনসিবির মাধ্যমে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি।’
তিনি জানান, এই চক্রের সদস্যরা বাবা-মায়ের অবাধ্য স্কুল-কলেজের বখে যাওয়া ছেলে-মেয়েদের টার্গেট করতেন। বিশেষ করে টিকটক গ্রুপে অন্তর্ভুক্ত করে তারা পাচার কাজে সহযোগিতা করছিলেন।
মো. শহিদুল্লাহ বলেন, ‘আমরা জানতে পেরেছি, ভারতে গ্রেপ্তার টিকটক হৃদয় টিকটকের একটি গ্রুপের অ্যাডমিন। সেই গ্রুপের মাধ্যমে গত বছরের শেষের দিকে ঢাকার পার্শ্ববর্তী জেলার একটি রিসোর্টে ৭০০ থেকে ৮০০ তরুণ-তরুণী পুল পার্টিতে অংশ নেয়।
‘মূলত টিকটক ভিডিও তৈরি করতে গিয়ে তরুণ-তরুণীরা পরস্পরের সঙ্গে পরিচিত হয়ে একটি ফেসবুক গ্রুপে সংযুক্ত হয়। যে ফেসবুক গ্রুপটির মূল পৃষ্ঠপোষক এই আন্তর্জাতিক মানব পাচার চক্রটি। যাদের মূল আস্তানা ভারতের ব্যাঙ্গালুরুর আনন্দপুর এলাকায়।’
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, এই গ্রুপে সুনির্দিষ্ট কিছু ছেলে গ্রুপের নারী সদস্যদের ভারতের বিভিন্ন মার্কেট, সুপার শপ, বিউটি পার্লারে ভালো বেতনে চাকরির অফার দিয়ে প্রলোভনে ফেলে ভারতে পাচার করছিল।
‘মূলত পতিতাবৃত্তিতে নিয়োজিত করার উদ্দেশেই বিভিন্ন বয়সের মেয়েদেরকে ভারতে পাচার করা হয়। এই চক্রটি ভারতের কয়েকটি রাজ্যের কিছু হোটেলের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ। হোটেলগুলোতে চাহিদা মাফিক বিভিন্ন বয়সের মেয়েদের নিয়মিতভাবে সরবরাহ করা হয় বলে আমরা তথ্য পেয়েছি।’
ডিসি শহিদুল্লাহ বলেন, ‘ভারতে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিরা অবৈধভাবে সেখানে গেছে, তাদের কোনো পাসপোর্ট, ভিসা নেই। মানবপাচার ও পর্নোগ্রাফি মামলায় এনসিবির মাধ্যমে দ্রুততর সময়ে তাদের আমরা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি।’
তিনি জানান, এ ঘটনায় ভারতেও মামলা হয়েছে। যেহেতু বাংলাদেশের মামলার প্রধান আসামিও টিকটক হৃদয়, তাই তাকেসহ অন্য সহযোগীদের জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ভারতে গ্রেপ্তার হৃদয় ঢাকার মগবাজার এলাকার বাসিন্দা। এলাকায় ‘টিকটক হৃদয় বাবু’ নামে পরিচিত। তিনি অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। এরপরে পড়াশোনা ছেড়ে বন্ধুদের নিয়ে টিকটক ভিডিও তৈরিতে জড়িয়ে পড়েন।
সম্প্রতি ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, এক তরুণীকে বিবস্ত্র করে শারীরিক ও যৌন নিপীড়ন করছে তিন-চার যুবক ও একটি মেয়ে। বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ জানায়, নির্যাতনের ঘটনাটি ভারতের কেরালার। তবে ভিকটিম ও নিপীড়কদের একজন বাংলাদেশি নাগরিক।
পুলিশের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে যৌন নিপীড়নকারী যুবকদের একজন হলেন ‘টিকটক হৃদয় বাবু’। ভারতে পুলিশেনর অভিযান পালানোর সময়ে পুলিশের গুলিতে আহত হন হৃদয় ও তার এক সহযোগী। পরে তাদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয। বর্তমানে তারা বেঙ্গালুরু সিটি পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার আছেন।
ফাঁদে ফেলে যে ভাবে নেয়া হতো ভারতে
বাংলাদেশের উঠতি তরুণ-তরুণীদের একটি অংশ এখন টিকটকসহ বিভিন্ন মিউজিক অ্যাপসমুখী। আর এই অ্যাপসকে ঘিরেই তৈরি হয়েছে বিভিন্ন গ্রুপ। গ্রুপের মাধ্যমে করা হয় বিভিন্ন আয়োজন। এখানেই মানবপাচার চক্রের জাল বিছিয়েছেন হৃদয়। এই গ্রুপের দায়িত্ব প্রাপ্তরা গ্রুপের নারী সদস্যদের ভারতের বিভিন্ন মার্কেট, সুপার শপ, বিউটি পার্লারে ভালো বেতনে চাকরির অফার দিয়ে প্রলোভনে ফেলতেন। এরপর নানা কৌশলে ভারতে নিয়ে যেতেন তারা। সেখান থেকে নেয়া হতো ব্যাঙ্গালুরুর আনন্দপুরায়। পরে কৌশলে মাদকদ্রব্য সেবন করিয়ে বা জোর করে বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ করতেন। এরপর ওই নারীদের হুমকি দেয়া হতো যে, তারা অবাধ্য হলে বা পালানোর চেষ্টা করলে এই ভিডিও তাদের পরিবারের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হবে। ফলে বাধ্য হয়ে ওই মেয়েরা অসামাজিক কাজে জড়িয়ে পড়তো।
সান নিউজ/আরআই